ঢাকায় ঈদের ইতিহাস কি পঞ্চাশ বা শত বছরের মাত্র?
আমার এই লেখা’র উদ্দেশ্য কি? না আমি কোন ইতিহাসের বিজ্ঞজন নই, তবে তথ্যসূত্র ক্রসচেক করে একটু সত্য’র দিকে দৃষ্টি হানা যায় কি না সেই চেষ্টা করছি। বাংলা একাডেমি’র মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান গত ঈদে ‘দৈনিক কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় ‘বাংলাদেশের ঈদোৎসব : ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেন, “বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত আব্বাসীয় খলিফাদের আমলের রৌপ্য মুদ্রা থেকে জানা যায়, অষ্টম শতকের দিকেই বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ফলে এই সুফি, দরবেশ ও তুর্ক-আরব বণিকদের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশে রোজা, নামাজ ও ঈদের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে সে যুগে তা ছিল বহিরাগত ধর্মসাধক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীদের ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব। এ দেশবাসীর ধর্ম সামাজিক পার্বণ নয়।
এ দেশে রোজা পালনের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় 'তাসকিরাতুল সোলহা' নামক গ্রন্থে। এ গ্রন্থে দেখা যায়, আরবের জনৈক শেখউল খিদা হিজরি ৩৪১ মোতাবেক ৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আসেন। বঙ্গদেশে ইসলাম আগমনপূর্বকালে শাহ সুলতান রুমি নেত্রকোনা ও বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুরের রামপালে আস্তানা গেড়ে (সেন আমলে) ইসলাম প্রচার শুরু করেন বলে জানা যায়। শেখউল খিদা চন্দ বংশীয় রাজা শ্রীচন্দের শাসনকালে (৯০৫-৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় আগমন করেন বলে অনুমান করা হয়। তবে তাঁদের প্রভাবে পূর্ব বাংলায় রোজা, নামাজ ও ঈদ প্রচলিত হয়েছিল, তা বলা সমীচীন নয়। তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে ওসব ইসলাম ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব পালন করতেন এ কথা বলাই সংগত। কারণ বাংলাদেশে 'নামাজ', 'রোজা' বা 'খোদা হাফেজ' শব্দের ব্যাপক প্রচলনে বোঝা যায়, আরবীয়রা নয়, ইরানিরাই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কারণ শব্দগুলো আরবি ভাষার নয়, ফার্সি ভাষার।”
তাই দেখা যায় নানা ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও সূত্র থেকে বাংলাদেশে রোজাপালন এবং ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ-উল-আজহা উদযাপনবের খবর পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও এদেশে নামাজ, রোজা ও ঈদপর্বের প্রচলন হয়েছে তার বেশকিছু আগে থেকেই। মির্জা নাথান তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘সপ্তদশ শতকের গোড়াতে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আরবি শাবান মাসের ২২তম থেকেই রোজার আয়োজন শুরু হতো। এ সময় থেকে মসজিদ সংস্কার ও আবাসিক গৃহাদি পরিচ্ছন্ন করার কাজ চলত। বাড়ির কর্ত্রী পানি ঠান্ডা রাখার জন্য নতুন সুরি ক্রয় করতেন। ইফতারের সময় এ ঠান্ডা পানি পান করা হতো। ইফতার সামগ্রী তৈরি করার জন্য গোলাপজল, কেওড়া ও তোকমা ব্যবহার করা হতো। সারা রোজার মাস ব্যবহার করার জন্য প্রচুর পরিমাণ পান ও পান মসলাও মজুত করা হতো।’
আরেক বিবরনে দেখা যাচ্ছে, সিয়ারে মুতাখ্খিরিণ গ্রন্থের প্রণেতা ঐতিহাসিক গোলাম হুসায়ন খান তাবতাবায়ী উল্লেখ করেছেন যে, ‘‘ঈদ উল আজহা ছিল আনন্দ স্ফূর্তি ও সকল মানুষের জন্য নতুন পোষাক-পরিচ্ছদ পরার একটি দিন। নবাব আলীবর্দীখানের ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা নওয়াজিশ মুহাম্মদ খান তাঁর প্রিয়জনের মৃত্যুর দরুন এমন আনন্দের দিনে শোক সমত্মপ্ত ছিলেন। এ জন্য বৃদ্ধ নবাব শোকার্ত জামাতার গৃহে আসেন এবং তাঁকে নতুন পোষাক-পরিচ্ছদ পরানোর জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে ঈদের আমেজ যাতে নষ্ট না হয় এজন্য তিনি তাঁর বেগম ও হেরেমের মহিলাদেরকে এই পূণ্যদিনের উপযোগী পোষাক-পরিচ্ছদ নিয়ে নওয়াজিশের নিকট পাঠান যাতে তাঁরা তাঁকে উৎফুল্ল করে তুলতে পারেন।’’
ফলে মোটামুটি ষোড়শ শতকের থেকে বঙ্গদেশে ঈদ উৎসব শুরু হয় বলে ধরে নেয়া যায়। ঢাকাবিষয়ক গবেষক দেলওয়ার হাসান 'নওবাহারই মুরশিদ কুলি খান' গ্রন্থের লেখক আজাদ হোসেনী বিলগ্রামীর লেখার বরাত দিয়ে লিখেছেন : '[si]নওয়াব সুজাউদ্দীনের অধীনস্থ মুরশিদ কুলি খান (১৭০৪-২৫ খ্রি.) ঈদের দিনে ঢাকার দুর্গ থেকে ঈদগার ময়দান পর্যন্ত এক ক্রোশ পথে প্রচুর পরিমাণ টাকাকড়ি ছড়িয়ে দিতেন। নওয়াবের সহযাত্রী হয়ে ওমরাহ, রাজকর্মচারী ও মুসলমান জনসাধারণ শোভাযাত্রা করে ঈদগা মাঠে যেতেন ঈদের নামাজ পড়তে।'
ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও সপ্তদশ শতকের কবি ভারতচন্দ্রের কবিতায় মুসলমানদের রোজা পালন সম্পর্কে সুস্পষ্ট দৃষ্টি পাওয়া যায়। মুকুন্দরামের বর্ণনায় শরিয়তি ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় নিষ্ঠা (প্রাণ গেলে রোজা নাহি ছাড়ে)-চণ্ডীমঙ্গল এবং ভারতচন্দ্রে সমন্বয়বাদিতার (দেবদেবী পূজা বিনা কি হবে রোজায় অন্নদামঙ্গল)। কবি মুকুন্দরামের চন্ডীকাব্যে রোজার বিবরণ উপস্থাপিত হয়েছে এভাবে-
ফজর সময়ে উঠি, বিছায়্যা লোহিত পাটি
পাঁচ বেরি করয়ে নামাজ
সোলেমানী মালা ধরে, জপে পীর পয়গম্বরে
পীরের মোকামে দেই সাঁজ।
দরবিশ বেরাদরে, বসিয়া বিচার করে
অনুদিন কিতাব কোরান
বড়ই দানিসমন্দ, কাহাকে না করে ছন্দ
প্রাণ গেলে রোজা নাহি ছাড়ি।
আসলে ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতক থেকে বঙ্গদেশে, বিশেষত ঢাকা’কে কেন্দ্র করে যে ঈদ উৎসব শুরু হয় তা রহিত এবং ক্রম বিলুপ্ত হতে থাকে ব্রিটিশ আমলে, বিশেষত কোরবানির ঈদ। কোরবানির ঈদকে এখনো বকরি ঈদ বলে অনেকেই অভিহিত করে থাকে। কিন্তু, যে শব্দ ‘বাকারা’ হতে এই বকরি ঈদ শব্দের আগমন, আরবি সেই ‘বাকারা’ শব্দের অর্থ গাভী। অসমর্থিত সূত্র মতে, ইংরেজ আমলে গরু কোরবানি দেয়াটা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পরলে বকরি তথা ছাগল দিয়ে কোরবানি দেয়া হয় এবং বকরি ঈদ শব্দটি প্রসার পায়। তো সে যাই হোক, ঢাকার নওয়াবদের প্রকাশিত ডায়েরি থেকে ঢাকা শহরে ঈদের কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় গত শতকের একেবারে শুরু’র দিকের যা উপরে বলা ঈদ উৎসবে উত্থান-পতনের পর পুনঃ উত্থানের সাক্ষী দেয়, ‘আজ রবিবার, পবিত্র বকরি ঈদ। নামাজ শেষে আমিও অন্যান্যের মতো কোলাকুলি করি। নওয়াব সাহেব আমাকে আদেশ দেন অন্যান্যকে নিয়ে বিনা খরচে ক্লাসিক থিয়েটারে নাটক দেখার জন্য। খাজা সলিমুল্লাহ তখন নওয়াব (কাজী কাইয়ুমের ডায়েরি)।' (১৯০৪ খ্রি. ২৮ ফেব্রুয়ারির ঈদের বর্ণনা)’।
বর্তমানে জীবিত সত্তর বা আশি বছরের প্রবীণদের জবানীতে তাদের দাদা/নানা’দের সময়কার কোরবানি ঈদের গল্প শোনার কথা জানা যায়। ফলে কোরবানি ঈদ এই দেশে কবে থেকে শুরু হয় তা কিন্তু ধোঁয়াশাই রয়ে যায়। শামসুজ্জামান খান তার ‘বাংলায় ঈদ, বাঙালির ঈদ’ নিবন্ধে বলেছেন ‘ঈদোৎসব শাস্ত্রীয় ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে দ্বাদশ শতকের বাংলায় ইসলাম এলেও চার/পাঁচশত বছর ধরে শাস্ত্রীয় ইসলামের অনুপুঙ্খ অনুসরণ যে হয়েছিলো তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সেকালের বাংলায় ঈদোৎসবেও তেমন কোনো ঘটা লক্ষ্য করা যায় না। এর কারণ হয়তো দুটি: এক. গ্রাম-বাংলার মুসলমানেরা ছিলো দরিদ্র; এবং দুই. মুসলমানের মধ্যে স্বতন্ত্র কমিউনিটির বোধ তখনো তেমন প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটা সামাজিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর অবস্থাও তখনো সৃষ্টি হয়নি। আর এটাতো জানা কথাই যে সংহত সামাজিক ভিত্তি ছাড়া কোনো উৎসবই প্রতিষ্ঠা লাভ করে না। বৃহৎ বাংলায় ঈদোৎসব তাই সপ্তদশ, অষ্টাদশ এমনকি ঊনবিংশ শতকেও তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। নবাব-বাদশারা ঈদোৎসব করতেন, তবে তা সীমিত ছিলো অভিজাত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে, সাধারণ মানুষের কাছে সামাজিক উৎসব হিসাবে ঈদের তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিলো না। তবে গোটা ঊনিশ শতক ধরে বাংলাদেশে যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন চলে তার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে নগর জীবন ও গ্রামীণ অর্থবিত্তশালী বা শিক্ষিত সমাজের ওপর।’
মূলত ঢাকা’কে কেন্দ্র করেই ঈদের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়, আর এটা খুবই স্বাভাবিক। কেননা, ঢাকা সেই মোঘল আমলেরও আগে থেকে বাংলার রাজধানী ছিল। আর যে কোন উৎসবের আনুষ্ঠানিক রুপায়ন সেখান থেকেই হবে এটাও স্বাভাবিক। তবে ঈদ উৎসব কোন মতেই চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর পূর্বের ইতিহাস বলে আমি মনে করি না। মূলত এই বাংলায় ঈদ উৎসবের উদ্ভব এবং বিস্তৃতি ষোড়শ শতকে যা অষ্টদশ এবং উনবিংশ শতকে রাজনৈতিক কারণে ম্লান থেকে ম্লানতর হতে থাকে এবং বিংশ শতকের শুরুর দিক থেকে তা পুনরায় বিস্তৃতি পেতে থাকে। যাই হোক হাটের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে আমি কি সব খুঁজে পেলাম, আর ছাইপাশ কি সব লিখলাম জানি না। সামনে কোরবানির পশুর হাট নিয়ে ভবিষ্যৎ কোন এক কোরবানির ঈদে লেখা যাবে যদি বেঁচেবর্তে থাকি। ;) :P :)
পোস্ট এর যে ছবি শুরুতেই দিয়েছি, তা আলম মুসাবগ্ধীর/আলম মুসাওয়ার এর যিনি ঊনিশ শতকের ঢাকার একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী যিনি তাঁর শিষ্যদের সমভিব্যবহারে ঢাকার প্রসিদ্ধ ঈদ ও মুহররম মিছিল এর ওপর চিত্ররাজি অংকন করেন। এগুলি ঢাকার সবচেযে় পুরানো জলরং এর ছবি। বর্তমানে এ ছবিগুলি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। আলম মুসাওয়ার/আলম মুসাবগ্ধীরের ব্যক্তিগত জীবন সমপর্কে কিছুই জানা যায় না। শুধু এটুকু জানা যায় যে, তিনি নওয়াব নুসরত জং-এর সমসামযি়ক ছিলেন। ধারণা করা হয় যে, নওয়াব নুসরত জং-এর পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি মিছিলের ওপর চিত্রসমূহ অব্জন করেছিলেন। তাঁর নামের শেষে ব্যবহৃত গুণবাচক বিশেষণের প্রতিশষ্ফ হলো ‘মুসাবগ্ধীর’ অর্থাৎ শিল্পী। সম্ভবত তাঁর পৃষ্ঠপোষক তাঁকে এ বিশেষণে ভৃষিত করেছিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষক শিল্প-সংস্কৃতির একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলে জানা যায়। আলম মুসাবগ্ধীর-এর ঈদ ও মুহররম মিছিলের ওপর অব্জিত চিত্রকর্মগুলি তার সমযে়র ঢাকার নওয়াব ও তাঁর অনুচর, কোমপানির কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সাধারণ জনগণ ও দুস্থদের জীবন-পদ্ধতি তুলে ধরেছে। এ চিত্রকর্মগুলিতে পুরনো ঢাকার নিদর্শনসমূহ-যেমন, নাযে়ব-ই-নাজিম-এর ঢাকাস্থ নিমতলী প্যালেস ও তোরণ-এর বিবরণ পাওয়া যায়। নিমতলীর তোরণটি বর্তমানে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এর প্রাঙ্গণে অবস্থিত। আলম মুসাবগ্ধীর ও তাঁর শিষ্যরা হাতে-তৈরী কাগজের উপর অব্জনের কাজ করেন। এ কাগজগুলি আকারে (২২২৮) মুগল চিত্র অপেক্ষা কিছুটা বড় ছিল। তাঁর অংকন-পদ্ধতিতে মুগল-চিত্র অব্জন রীতি ও কোমপানির (ব্রিটিশ) চিত্র অংকন-রীতির সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। তিনি তাঁর চিত্রকর্মে দেশীয় রংবিন্যাস প্রযে়াগ করেছেন এবং সেখানে ইউরোপীয় চিত্রানুপাতের কিছু লক্ষণ দেখা যায়। আলম মুসাবগ্ধীরের রঙিন চিত্রাব্জনগুলি ঢাকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরূত্বপূর্ণ বাস্তব দলিল।
তথ্যসূত্রঃ
• ঢাকার ইতিহাস – হাকিম হাবিবুর রহমান
• http://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDhfMDVfMTNfM181OV8xXzYyMDA1
• http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2014/07/28/111680/print
• ‘বাংলায় ঈদ, বাঙালির ঈদ’ - শামসুজ্জামান খান
• ঢাকা সমগ্র ১’ - মুনতাসীর মামুন
No comments