Header Ads

Header ADS

স্মৃতিতে পুরান ঢাকার কুরবানী হাট

কুরবানী ঈদ আসলে সবচেয়ে আলোচনায় থাকে পশুর হাট এবং সেখানে পশুর দাম। আসলে ঈদুল আজহার প্রায় পুরো কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে এই হাট এবং তার বিষয়ক আলোচনা। শহুরে জীবনে বসবাসের কারণেই কি না শৈশবে কুরবানী ঈদ আসলেই পশুর হাট নিয়ে থাকতো খুব উত্তেজনা। দল বেঁধে এই হাট সেই হাটে ঘোরাঘুরি। শুরুর দিকেই কোন গরুর বেপারীর পাশ থেকে চুপিসারে একটা লাঠি চুরি করে নিজের দখলে নিয়ে হাটে সারাদিন ঘোরাঘুরি। এলাকার কেউ পশু কিনতে রওনা হলে ছেলেপুলের দল তাদের পিছু পিছু হাটে চলে যেতাম। সারাদিন এই করে কেটেও ক্লান্তি আসতো না। বরং রাতের বেলাই বেশীরভাগ মানুষ পশু কিনে আনতো, আর তাই নিয়ে আমাদের দুঃখের কোন অন্ত ছিলো না। ভাবতাম, আহারে যদি বড় হতাম!! অথচ বড় হওয়ার পরে সেই আমাদের মাঝেই নিজেদের পশু কিনতে হাটে যেতেও এখন অনীহা, বিরক্তি। আর এখন তো হাটের সংখ্যাও গেছে কমে। 

বর্তমানে ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন মিলে বিশটি’র মত (উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় বসানো হচ্ছে ৮টি অস্থায়ী পশুর হাট; অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় বসতে যাচ্ছে ১০টি অস্থায়ী পশুর হাট।) হাট বসছে। আমি নিজে বছর ত্রিশেক আগে, কৈশোরবেলায়, স্কুল জীবনে পুরাতন ঢাকার নয়াবাজার থেকে হাজারীবাগ এলাকায় আট দশটি হাট বসতে দেখেছি। হাজারীবাগ খেলার মাঠ, নবাবগঞ্জ বালুঘাট, কিল্লার মোড়, লালবাগ পলাশী বালু মাঠ, চানখারপুল, রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ, নয়াবাজার হাটের কথা স্পষ্ট মনে আছে। অথচ অত্র এলাকায় এখন হাট বলতে হাজারীবাগ আর রহমতগঞ্জ হাট রয়েছে। আধুনিক নগরায়ন জীবনধারায় এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্মৃতিচারণ ভুবনে সেই হাটগুলোর স্মৃতি নষ্টালজিক করে তোলে। 

পুরাতন ঢাকার মধ্যে রহমতগঞ্জ খেলার মাঠের হাট বিখ্যাত ছিলো এবং আছে মীরকাদিম এর গরুর জন্য। মায়াবী চেহারার গরুগুলো দেখতে আমরা বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হতাম। আর শহরের সবচেয়ে দামী গরু দেখার জন্য, যারা একটু বেশী ডানপিটে এবং দুঃসাহসী ছিলো, তারা আয়োজন করে কোন একদিন চলে যেত নয়াবাজার আর গাবতলী হাটে। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতা চলতো, কে কোন কোন হাটে কয়বার গিয়েছে, সবচেয়ে দামে কয়টা গরু বিক্রি হতে দেখেছে। তার সাথে হাটে হাটে গিয়ে পশুদের উত্যক্ত করা আর বড়াদের চোখ রাঙ্গানী, কখনো দৌড়ানি খেয়েও ক্ষ্যান্ত দিতাম না। আহ, অন্য রকম এক সারল্যে ভরা আনন্দমুখর শহুরে শৈশবের পুরাতন দিনগুলো। 

আরেকটা ব্যাপার ছিলো, হাট নিয়ে নানান মাস্তানদের নাম শোনা, তাদের সম্পর্কে কল্প গল্প’গুলো ছিলো আমাদের ছোটদের কাছে ঠাকুরমার ঝুলির গল্পগুলোর চাইতেও বেশী আকর্ষক। বছর ত্রিশেক আগেও ঢাকা শহরে প্রতি বছর হাট ইজারা, হাটে গরু উঠানো এবং এই সম্পর্কিত মারামারি-খুনাখুনি’র ঘটনাও কম আলোচনায় থাকতো না। আগে পুরাতন ঢাকায় এলাকাভিত্তিক নানান মাস্তান এবং ক্যাডার বাহিনী ছিলো, ছিলো তাদের প্রতিপক্ষও। আর ঈদুল আজহা আসলে হাটের ইজারা নিয়ে এই দুই গ্রুপের মধ্যে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করতো। তার সাথে পুরাতন ঢাকায় হাটও বসতো বেশ অনেক জায়গায়। ফলে পাশাপাশি দুইটা হাটের ইজারাদারই নানান স্থানীয় পাতি মাস্তান ভাড়া করতো ঢাকার বাইরে থেকে হাটে পশু নিয়ে আসা ব্যাপারীদের নিজ নিজ হাটে ভেড়াতে। আগে বেশীরভাগ গরু আসতো বুড়িগঙ্গা হয়ে নৌপথে, তাই এই নৌপথেই ছিল সবার দখলদারিত্বের দৌড়ঝাঁপ বেশী। স্কুল পেরোনের অনেক পরে কোন এক কুরবানী ঈদে আমাদের পাশের এলাকার এরকম পাঁচ উঠতি মাস্তান টাইপের ছেলে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়, যা এলাকায় বেশ আলোড়ন ফেলেছিলো। 

কুরবানী হাটে পশুদের সজ্জার জন্য আগের মত নানান ঝালর, গলার মালা এখন খুব একটা দেখা যায় না, আগে যা খুব বেশী দেখা যেত। বড় শিং ওয়ালা গরুগুলোর শিং এর মাঝেও লাল রঙের টুপি তথা কাভার পরানো হতো, সেগুলো দেখতে বাচ্চারা ভীড় করতো। আর তার সাথে কোন এলাকার কোন বাড়ীতে বড় কোন গরু এসেছে তার খোঁজ চলতো সারাদিন, খবর পেলেই ভোঁ দৌড়….

আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষদের কুরবানির ঈদ্গুলো হয়ত ছিলো আরও অনেক মধুর স্মৃতিময়। আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে সেই স্মৃতি আবার অন্যরকম। আর বর্তমানে অনলাইন এবং নানান খামারে গরু প্রতিপালন, লাইভ ওয়েটে গরু বিক্রি চলছে। ভবিষ্যতে হয়তো বসবে না আর উন্মুক্ত গরুর হাট, সব চলবে অনলাইনে, গরু থাকবে খামারে, স্ল্যাটার হাউজে জবাই হয়ে বাসায় সরাসরি মাংস চলে আসবে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মত। সেটাই হয়তো সবচাইতে উত্তম, কিন্তু আমরা যারা ভিন্নতর ঈদ দেখেছি এই জীবনকালে তারা প্রতিবছর কুরবানী ঈদ আসলে অল্প বিস্তর হলেও স্মৃতিকাতর হবো, সবার অগোচরে হয়তো দু’একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবো অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে, হয়তো ব্যস্ত নাগরিক জীবনে ভুলে যাবো সেই সব স্মৃতিময় ঈদের সময়গুলো। ইতিহাসের হাজারো পাতার ভীড়ে চাপা পরবে সেই স্মৃতির পাতাগুলো...

No comments

Powered by Blogger.