ছেলেটি এবং মেয়েটির পরীক্ষা দেয়া হল না
ছেলেটি
প্রথমদিন মেয়েটিকে ক্লাসে দেখার সাথে সাথে আমার মনে হল আমি কোন কাল্পনিক জগতে হুট করে এসে পড়েছি। মেয়েটি ছাড়া আমার জগতের আর সবকিছু যেন অদৃশ্য হয়ে উঠল। ঘটনার শুরু ক্লাসের জানালার ঘোলাটে কাঁচে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েটির মুখচ্ছবি দেখার মধ্য দিয়ে। কি লম্বা কুচকুচে একগোছা চুল ছড়িয়ে রাখে পিঠের উপর। সেই কালো চুল দেখে আমি প্রথমবারের মত বুঝলাম যুগে যুগে এতো পুরুষ মানুষ কেন ঘন কালো চুলের প্রেমে দিশা হারিয়েছিলেন। টানা টানা কাজল মাখা চোখ, আমার কল্পনাও হতে পারে অথবা বাই নেচারালি তার চোখ এমন হতে পারে, কিন্তু সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন অদ্ভুত একটা শিরশিরে অনুভূতির সাথে হঠাৎ করেই আমি নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে শুরু করি। ক্লাসে বরাবরের মত সুনাম আমার সেই ছোটকাল থেকেই ছিল, আর মনোযোগে ব্যাঘাত বা ঘাটতি ঘটার মত কোন কারণ আমার জীবনে কখনই ঘটেনি। কিন্তু সেইদিন থেকে আমার ছোট্ট জীবনের অনেক অনেক দীর্ঘসময় ধরে মেনে চলা নিয়মগুলো সব পাল্টে যেতে লাগলো।
প্রতিদিন ক্লাস শেষে তাকে দেখার সুযোগ হারানোর ক্ষণে মনে হয় এইতো বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর ঝুপ করে আসবে রাত। রাতটুকু পার করে দিতে পারলে পরের দিন আবার তাকে দেখা যাবে। এই আশা নিয়ে সেই ঝুপ করে নেমে আসা রাতগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো। সাথে এই আমি, আমার ভেতরের আমি কেমন বদলে যেতে লাগলাম। খেতে বসে ভাতগুলো সব কেমন তিতকুটে বিষের মত ঠেকল আমার স্বাদহীন জিহবার মাঝে, তাইতো আম্মুকে জীবনে প্রথমবার ঝাড়ি দিয়ে উঠে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম সাদা ভাতের ধবধবে সাদা কাঁচের প্লেটটি। প্লেট ভেঙ্গে খানখান হওয়া আমি দেখেও না দেখার ভান করে আমার রুমে চলে এলাম, কিন্তু দেখতে পাইনি আম্মুর বুকটা ভেঙ্গে খানখান হওয়াটুকু।
প্রথম সপ্তাহ আমার এই ঘোলাটে কাঁচ ভেদ করে চোরা দৃষ্টি দিয়ে স্বপ্নকন্যার রূপের অবয়বের সুধা পানের মুগ্ধতা ধরা পড়ল না। কিন্তু সপ্তাহখানেকের মাথায় একদিন স্বপ্নকন্যা আবিস্কার করলো আমার চোরা চাহনি। আমি বিস্মিত হয়ে আবিস্কার করলাম সেও ক্ষণে ক্ষণে সেই ঘোলাটে কাঁচ ভেদ করে আমার চোরা দৃষ্টির খোঁজ করে নিয়মিত বিরতিতে আর তাতে করে প্রতিবার যেন একটা করে হার্টবিট মিস করে আমার ধুকপুক করতে থাকা হৃদপিণ্ডখানি। চারচোখের যদি একতান হত ক্ষণিকের তরে তবে তার মুখে খেলে যেত অপার্থিব মিষ্টি এক হাসি, যেই হাসি আমার সেদিনকার রাতের ঘুম কেড়ে নিতে যথেষ্ট ছিল। আসলে কি তাই, এমনিতেই তো আমার ঘুমগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল সেই প্রথমদিন থেকেই। আমার চোখের নীচে কালি আর খিটখিটে মেজাজ আম্মুর কপালে চিন্তার রেখা ফেলছিল কি না আমি খেয়াল করি নাই। আপু আর ভাইয়ার বাঁকা চোখে তাকানো সেটাও খেয়াল করি নাই, খেয়াল করি নাই বন্ধুদের আড্ডা থেকে কতটা দূরে চলে এসেছি আমি।
একদিন বিকেলে ক্লাস শেষে তাকে সাহস করে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘তোমার সাথে আমার কথা আছে’। ‘কি কথা?’ ঘাড় বাকিয়ে সেই মায়াময় চোখে কিছুটা বিষণ্ণতা মাখা অবহেলা মিশিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল। হয়ত তা আমার মনের ভুল ছিল অথবা হয়ত না, কিন্তু আমি সেদিন বলেছিলাম, ‘এখানে না অন্য কোথাও বলব’। ও কেমন একটা হাসি দিয়ে বলেছিল, ‘তাহলে হোস্টেলের গেটে এসে বলতে চাও?’। আমি কেমন লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে সম্মতিসুচক কথা বললতেই ও খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। তারপর হোস্টেলের গেটে কি কি বলেছিলাম, স্পষ্ট করে আজ তা মনে নেই। শুধু মনে আছে বলেছিলাম, ‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না’। ও হেসে বলেছিল, ‘খুব বেশী সিনেমা দেখ বুঝি?’ আর বলেছিল, সে সেই সুদূরের জেলা হতে এই বিভাগীয় শহরে এসে বন্ধুহীন, তার একজন খুব ভাল বন্ধু দরকার। কিন্তু আমি বন্ধু হতে তো চাইনি। তাহলে আমি কি হতে চেয়েছিলাম? প্রেমিক? আজও নিজে ভালমত বলতে পারবো না।
সেদিনের পর থেকে আমি নিয়মিত ঘুমের ঔষধে নিজের দুঃখ ভুলানোয় খুব ব্যস্ত হয়ে গেলাম, কিন্তু ভুলাতে পারলাম না সেই মায়াবী চাহনি, সেই মিষ্টি হাসি আর সেই দীঘল কালো কেশের রাজ্যকে। এর মাঝে টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট চলে এল, তিন সাবজেক্টে ফেল করে গার্জিয়ান নিয়ে ধর্না দিয়ে ছাড়পত্র মিলল ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার। কিন্তু এর মাঝে হুট করে হারিয়ে গেল আমার স্বপ্নকন্যা, কোন খোঁজ নেই তার। ক্লাসে অনুপস্থিতিতে কয়েকদিন নিজে দিশেহারা থেকে অবশেষে শরণাপন্ন হলাম তার সাথে থাকা হোস্টেলের মেয়েগুলোর, কিন্তু কোন কিছুই জানা গেল না। শেষে হাস্যকর ঠিকানায় তার হোস্টেলে চিঠি পাঠাতে লাগলাম, দুই সপ্তাহে তিনটি চিঠি, শুধু তার নাম আর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে হোস্টেলে চিঠি!
এইচএসসি পরীক্ষার তখন আর এক মাস বাকী, সারাদিন আমি পথে পথে হেঁটে বেড়াই উদ্দেশ্যহীনভাবে আর রাতের বেলা ঘুমের ট্যাবলেট সম্বল করে চোখের জ্বালা কমাতে ব্যস্ত থাকি। এর মাঝে হঠাৎ একদিন একজনের মাধ্যমে খবর পেলাম ও আমার সাথে দেখা করতে চায় হোস্টেলের গেটে। আমি বুঝি খুশীতে জমে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। পরেরদিন বিকেলে তার হোস্টেলের গেটে গিয়ে দেখা করলাম, তারপর আমার স্বপ্নগুলো চিরতরে হারিয়ে ফেললাম। আর স্বপ্ন যখন হারিয়ে যায় তখন কি বেঁচে থাকা যায়? আমার স্টকে থাকা ঘুমের বড়িদের মুক্তি দিতে এক বিকেলে নিজ ঘরে তাদের চালান করে দিলাম আমার ভেতরে। এরপর পরিবারের সবার চোখের জল আর চিকিৎসাবিদ্যার কল্যাণে আমি আমার স্বপ্ন হারানোর মত চিরতরে হারিয়ে যেতে পারলাম না। এর মাঝে আমার ফাইনাল পরীক্ষা চলে গেল, আমার আর পরীক্ষাটা দেয়া হল না।
মেয়েটি
মেয়েদের নাকি তৃতীয় একটা নয়ন থাকে, অনেকটা অতিরিক্ত একটা অনুভূতি। এটা আমার মায়ের কথা, যা আমাকে বড় হয়ে ওঠার ক্ষণে মা শিখিয়েছিল। সেই তৃতীয় নয়নের বলে আমি দেখলাম একটা ছেলে অবিরত আমাকে ফলো করে যায় ক্লাস চলাকালে, তাও একটা ঘোলাটে জানালার কাঁচে আমার প্রতিবিম্ব দিয়ে। আমি প্রথমে খুব মজা পেলাম, নিয়মিত লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম তার কর্মকাণ্ড। অবাক হয়ে দেখলাম, সে ক্লাসে কোন কিছুতেই মনোযোগী নয়, তার কাজ বুঝি ঐ কাঁচের জানালার দিকে একমনে তাকিয়ে থাকা। কেননা, আমি যখনই সেদিকে লক্ষ্য করি, দেখি সে অপলক চেয়ে আছে। প্রথম দুয়েকদিন ব্যাপারটা খুব মজার লাগল, কিন্তু তারপর কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো। একজন কেউ সারাক্ষণ আমার দিকে চেয়ে আছে ভাবতে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল। ঘিনঘিনে বলব না, কেননা তার চাহনিতে কোন নোংরামি ছিল না, ছিল অদ্ভুত এক মায়ালাগা ঘোর। কি শিশুসুলভ চাহনি নিয়ে বেচারা চেয়ে থাকত, মাঝে মাঝে খুব মায়া লাগত তার জন্য। আর তাইতো ও যখন একদিন সাহস করে ক্লাস শেষে কথা বলতে চাইল, আমি হোস্টেলের গেটে তাকে দেখা করতে আসতে বললাম, কথা বলতে। আমি সেদিন না করতে পারি নাই। কেন? আমি জানি না।
আমি নিজের বাড়ীঘর ছেড়ে এই শহরে এসেছিলাম উচ্চশিক্ষা পোক্ত করতে আর আমার সহজ-সরল মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে। কিন্তু এই শহরে আমি কারো সাথে মিশতে পারছিলাম না, হোস্টেলের মেয়েগুলোকে কেমন যেন ইঁচড়ে পাকা মনে হত। ওদের চালচলন, ঘোরাফেরা, কথাবার্তা কোনকিছুর সাথেই আমি মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। ফলে কারো সাথে আমার তেমন সখ্যতা গড়ে ওঠে নাই, আমি ছিলাম আমার নিজের ছোট্ট ভুবনে, একাকিনী। ভালই ছিলাম, এতোটুকু বলতে পারি। শুধু আমার শারীরিক কষ্টগুলো নিয়মিত আমাকে জ্বালাতন করে যাচ্ছিল। আমার রিউমেটিক ফিভার, সাইনাস সহ আরও কত যে সঙ্গী এই দেহে সেই বয়স থেকেই বাসা বেঁধেছিল বলার না। সেগুলোর সাথে বোঝাপড়া করে করে আমার বেশীরভাগ সময় কেটে যায়। এর বাইরের সময়টুকু ঢেলে দিতে চেষ্টা করি পড়াশোনার মাঝে, যার জন্য আমি নিজ ভুবন ছেড়ে এখানে এসেছি।
কিন্তু ছেলেটা যে, সরাসরি আমাকে প্রেমের প্রস্তাব করে দিবে তা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারি নাই। আমি কিছুটা অবাক, কিছুটা অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে তার সবকথা শুনে গেছি। কি সব ছেলেমানুষি আর হাস্যকর কথা, আমি তার আকাশ-বাতাস, চাঁদ-তাঁরা-সূর্য আরও কত কি? বুঝেছি এই ছেলের মাথার স্ক্রু লুজ হয়ে গেছে, তাই আমি কোন কঠিন রিঅ্যাক্ট করি নাই। শুধু বলেছিলাম, এই শহরে আমি খুব একা, আমার একজন বন্ধুর দরকার। কিন্তু আমাকে হতবাক করে দিয়ে ও বলেছিল, ‘আমি বন্ধু হতে আসি নাই...’। আমি তার সাথে আর কোন কথা না বাড়িয়ে হোস্টেলের রুমে ফিরে আসি।
টেস্ট পরীক্ষার পর পর আমার শরীর অতিরিক্ত রকমের খারাপ হলে আমি বাসায় চলে আসি। আরও অবনতি হলে আমাকে হসপিটালাইজড করা হয়, সপ্তাহ দুয়েক সেখানে থেকে শরীরটাকে রিপেয়ার করে আমি বাসায় ফিরি। তারও সপ্তাহখানেক পর হোস্টেলে আসি আমার জিনিষপত্র সব নিয়ে যেতে, কেননা শরীরের অবস্থা দেখে আব্বু বলেছিলেন বাসায় থেকে বাকী সময়টা পড়ালেখা করতে, পরীক্ষার সময় না হয় আবার ফিরে গিয়ে শুধু পরীক্ষা দেয়া যাবে।
আমি যেদিন হোস্টেলে ফিরি সেদিন গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখি চেনা সব মুখগুলো কেমন মুচকি হাসছে আমাকে দেখে। গেটের দারোয়ান মামা হতে শুরু করে আমার রুমমেট সবাই। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন সবাই এমন করছে, কিন্তু কোন একটা কারণ তো অবশ্যই আছে। থাক গিয়ে, আমি আমার মত করে নিজের জিনিষপত্র গুছাতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর আয়া খালা এসে জানালো হোস্টেল সুপার ম্যাডাম আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, এখনই যেন উনার সাথে দেখা করি। আমি সব জিনিষপত্র এলোমেলো রেখে তখনি উনার সাথে দেখা করতে গেলাম। উনি আমাকে যে শব্দ ব্যবহার করে কথাগুলো বলেছিলেন, তা আজও কানে বাজে, আর বাজা মাত্রই আমার শরীর উগড়ে বমি চলে আসে।
তিন তিনটা উদ্ভট চিঠি এসেছিল আমার নামে, কিন্তু ঠিকানা ছিল গ্রামের নামে। এখনো মনে আছে, আমার নামের নীচে লেখা ছিল, পাবে দিয়ে আমার নাম, বাবার নাম আর গ্রামের নাম। তারপর হোস্টেলের ঠিকানা। সেই চিঠি আর চিঠির লেখা দেখে আমি বুঝেছিলাম এটা কার কৃতকর্ম। হোস্টেল ছেড়ে আসার আগে আমি তার সাথে দেখা করেছিলাম, প্রথম এবং শেষবারের মত কঠিন কিছু কথা বলেছিলাম। আজ এতো বছর পরে মনে পড়ছে না, ঠিক কি কথা বলেছিলাম। কিন্তু খুব মনে আছে আমার হোস্টেল সুপারের সেই অশ্রাব্য কথাগুলো। হোস্টেল সুপারের সেই বিশ্রী কথাগুলো আমার মাথার মাঝে কেন যেন খুব বেশী তীব্র হয়ে বিঁধেছিল। আমি সেদিনই হোস্টেল হতে বাসায় ফিরি, সারা রাস্তায় চোখের জলে গাল ভিজিয়ে। তারপর বাসায় এসে আবারো অসুস্থ হয়ে পড়ি, আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশী। আবারো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় আমাকে, আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য। আর মোটামুটি সুস্থ হয়ে আমি যখন বাসায় ফিরি, ততদিনে আমার পরীক্ষার তারিখ পেড়িয়ে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে গেছে। আমার আর পরীক্ষাটা দেয়া হল না।
No comments