Header Ads

Header ADS

কুঁড়িয়ে পাওয়া সাজা

সন্ধ্যার দিকে মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে, নিয়ন আলোয় ভেজা পিচঢালা পথ ধরে হেঁটে যেতে মন্দ লাগছে না। আমি আনমনে কতটা সময় ধরে হাঁটছি তা বলতে পারবো না, ঘণ্টাখানেক? অথবা ঘণ্টা দুই/তিন? হাতঘড়ি পড়া ছেড়েছি অনেকদিন হল, খুব বেশী প্রয়োজন হলে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে সময়টা দেখে নেই। বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলেও আকাশে এখনো মেঘ রয়েছে, টুকরো টুকরো মেঘের দল ছুটে বেড়াচ্ছে রাতের আকাশে। গত পরশু পূর্ণিমা ছিল, আজও আকাশের বুকে বিশাল চাঁদ রয়েছে, থেকে থেকে যা লুকোচুরি খেলছে নিকষ কালো মেঘেদের সাথে। মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ মুখ দেখালে সেই আলোতে রাতের মেঘাচ্ছন্ন অপার্থিব এক আকাশ ধরা দিচ্ছে। আজ মন খারাপের দিনে এই অপরূপ প্রকৃতিও আমাকে তেমন একটা ছুঁয়ে যেতে পারছে না। আমার নিকেতনের বাসা হতে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে উত্তরা পেড়িয়ে আমি টঙ্গি রোডে চলে এসেছি। টঙ্গি ব্রিজ পেরিয়ে একটা চায়ের দোকান দেখে থামলাম, এক কাপ চা খাওয়া দরকার।

চায়ের অতি বিস্বাদ স্বাদও আজ আমার অনুভূতি ছুঁয়ে যাচ্ছে না। আসলে, কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যা আর সব অনুভূতিকে গ্রাস করে নিয়ে বড্ড একাকী করে দেয় মানুষকে। আর তেমন কোন সম্পর্ক যখন ভেঙ্গে যায়, তখন মানুষ সত্যিকারের নিঃসঙ্গ হয়ে যায়, ভয়াল একাকীত্ব তাকে গ্রাস করে নেয়। নিঃসঙ্গতার এক অতল গহবরে মানুষ ভীষণভাবে তলিয়ে যায়। সেই অতলে, যেখানে কোলাহলের মাঝে বাস করেও মানুষ অদ্ভুত এক শুন্যতায় বাস করে। আমার দশাও ঠিক তেমনটাই। চা শেষ করে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে এক শলাকা ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। রাত ভালই হয়েছে, রাস্তার লাগোয়া সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে বেশীরভাগই। আজ খুব নিকোটিনের তেষ্টা পেয়েছে বুঝি, চেইন স্মোকারের মত সিগারেট পোড়াতে লাগলাম একের পর এক। হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেটে সুখটান দিচ্ছি, এমন সময় মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। এমন উদ্ভট রিংটোন কবে সেট করেছি নিজেই অবাক হলাম। পকেট হতে মোবাইল বের করে দেখি কোন কোল আসে নাই। কিন্তু তখনো মোবাইলে রিং হচ্ছে, পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি ফুটপাথের উপর একটা মোবাইল এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে কি মনে করে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। নকিয়া লুমিয়া সিরিজের ফোন, ইনকামিং নাম্বারটা “Aammu” নামে সেভ করা। যার ফোন হারিয়েছে, তার মা নিশ্চয়ই ফোন করেছে, অথবা মায়ের ফোন হতে সে ফোন করে ট্রাই করছে। দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ফোন রিসিভ করলাম।

‘হ্যালো?’
‘সোহেল? কতক্ষণ ধরে তোকে ফোন করছি? ফোন ধরছিস না কেন?’
‘হ্যালো... দেখুন আমি সোহেল না?’
‘সোহেল না? সোহেলের কলিগ? সোহেল কোথায়? ওকে দাও একটু’
‘আপনি বুঝি সোহেলের মা বলছেন?’
‘হ্যাঁ... ’

‘দেখুন আমি এই ফোনটি এইমাত্র রাস্তা হতে কুঁড়িয়ে পেয়েছি। আমি এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, আপনার কলে মোবাইলে রিংটোন বেজে ওঠায় আমার নজরে এল...’

‘ওহ... ছেলেটা যে কবে মানুষ হবে? আবারো মোবাইল হারিয়েছে। গত চারমাসে তিনবার মোবাইল হারিয়েছে।’

‘অ্যান্টি আপনি চিন্তা করবেন না, আমি মোবাইলটা আপনার বাসায় পৌঁছে দেব। আপনি ঠিকানাটা বলুন, আমি এক্ষনি নিয়ে আসছি।’

‘না বাবা, এতো রাতে দরকার নেই। গাধাটা বাসায় আসুক আজ, তোমার বাসা কোথায়? তুমি কোথায় মোবাইলটা পেলে’

‘আমি নিকেতনে থাকি, উত্তরা রাজলক্ষ্মী বাস স্টপেজের কিছুটা দূরে ফুটপাথে পেয়েছি মোবাইলটা।’

‘সোহেলের অফিস উত্তরা আব্দুল্লাহপুর কি না। ও না হয় আগামীকাল তোমার সাথে যোগাযোগ করে ফোনটা নিয়ে নিবে।’

‘ঠিক আছে অ্যান্টি’

‘ভালো থেকো বাবা...’

লাইনটা কেটে গেল। একবার ভাবলাম মোবাইলটা সুইচ অফ করে দেই, রাতে আবার জানি কার কার ফোন আসতে থাকে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, প্রিয়জনদের কাঙ্ক্ষিত কলগুলো রাতের বেলা আসে। পরক্ষণে মনে হল না থাক, সোহেল যদি কোন কারণে বা প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে চায়। কত দরকারি নাম্বার বা তথ্যই তো থাকতে পারে এই মোবাইলে। তাই আর সুইচ অফ করলাম না, বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। 

প্রতি রাতের মত আজ রাতও নির্ঘুম কাটাতে হবে হয়ত, ডাক্তারের পরামর্শে প্রতিদিন ঘণ্টাখানেকের জায়গায় দুই/তিন/চার ঘণ্টা অজানার পাণে হেঁটে হেঁটে কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরি। কিন্তু পোড়া চোখ ক্লান্ত হয় না, ক্লান্ত হয় না ভালবাসার স্মৃতিগুলো।

প্রতি রাতই নির্ঘুম কেটে যায়, ঊষা লগ্নের মায়াবী প্রথম আলোয় পবিত্র বাতাস গায়ে লাগলে বুঝি হৃদয়ের গোপন উনুনে জ্বলন্ত বেদনাগুলো একদণ্ড শীতল হয়। ঠিক তখনই বিছানায় ক্লান্ত মনের শান্ত দেহখানি এলিয়ে দিলে ঘুমের রাজ্যে আমার কিছুটা বিচরণ করার সৌভাগ্য হয়। এদিনও ব্যত্যয় হয় নাই, ভোরবেলা ঘুমুতে গেলাম, কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানা নেই, মোবাইলের রিংটোনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। অপরিচিত রিংটোন, কালকের সেই কুঁড়িয়ে পাওয়া কোন এক সোহেলের মোবাইল ফোন হতে। ফোন হাতে নিয়ে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভারী কণ্ঠের এক পুরুষের ধ্বনি কানে ভেসে এল...

‘হ্যালো, আপনি কে বলছেন?’
‘জ্বী আমি মিজান বলছি, আপনি কি সোহেল বলছেন?’
‘জ্বী না, আমি উত্তরা থানার এস.আই মনতাজউদ্দিন বলছি’

‘জ্বী বলুন...’ আমি ঘড়ির অভাব বোধ করলাম। মোবাইলে চেয়ে দেখি বেলা দশটা বাজে। আমি সবসময় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমুতে যাই, তার সাথে টানা থাকে মোটা পর্দা, তাই আলো দেখে ঠাহর করার উপায় নাই কয়টা বাজে। আমি একটু অবাক হলাম, মোবাইল আমি পেয়েছি এবং সেটা সোহেল সাহেবের মা’কে জানিয়ে বলেছলাম আমি নিজেই দিতে আসব। কিন্তু উনি না করলেন, বললেন ছেলে তার কাছ থেকে নিয়ে নিবে। তো তা না করে এই সাত সকালে থানা-পুলিশ..., যদিও সাত সকাল বলা ঠিক না, বেলা তো দশটা বাজে... চোখে ঘুমের রেশ রয়ে গেছে। 

‘আপনি এক ঘণ্টার মধ্যে থানায় আসতে পারবেন?’
‘জ্বী পারবো, কিন্তু ঘটনা কি?’

‘থানায় আসুন, তারপর বলা যাবে’ বলেই খট করে লাইন কেটে দেয়া হল। আমি কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে কিছুক্ষণ খাটে বসে রইলাম। খানিক পরে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে বাসা থেকে বের হলাম। রমিজের হোটেলে গরম সিংগারা আর চা দিয়ে নাস্তা সেরে রওনা হলাম থানার উদ্দেশ্যে। এই রওনা ছিল আমার শেষ রওনা, থানায় যাওয়ার পর আর আমার ফেরা হয় নাই নিজ বাসাতে। 

পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞসাবাদ শেষে আমাকে সন্দেহভাজন হিসেবে থানায় আটকে রাখা হয়। এরপর সব ঘটনা কেমন দ্রুত ঘটে যায়, যার কোন ব্যাখ্যা নেই। সোহেলের লাশ টঙ্গি ব্রিজের কাছের সেই দোকানের পাশের এক ডোবা থেকে উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্তে যে সময়ে সোহেলের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়, ঠিক তার পরপরই আমি ঐ দোকানে চা-সিগারেট পান করেছিলাম। সেই দোকানদারসহ আরও দুজন সাক্ষী দিয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার যে চাকু দিয়ে সোহেলকে উপর্যুপরি আঘাত করে খুন করা হয়েছে তাতে যে ফিঙ্গার প্রিন্ট রয়েছে সেটা নাকি আমার হাতের সাথে মিলে গেছে! মফস্বল থেকে ভাগ্যান্বেষণে ঢাকায় আসা পিতামাতাহীন এই আমি, যায় হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার দুঃখস্মৃতি ছাড়া তেমন কোন সম্বল নেই, সে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে গেছি। খুনের মামলার আসামী হিসেবে এখন আমি হাজতে আছি।

অফটপিকঃ গল্পটা হুট করে এখানেই শেষ করে দিলাম। পাঠক অনেক কিছু ভাবার অবকাশ পাবে। মিজান কি কোন সাইকো কিলার ছিল? নাকি সে ঘটনাক্রমে জড়িয়ে গিয়েছিল এই মামলায়। পুলিশবাহিনী কোন কারণে মিজানকে আসামী সাজিয়ে দিয়েছিল এই মামলার? এই অংশটুকু অমিমাংসিতই থাকুক না হয়।

No comments

Powered by Blogger.