Header Ads

Header ADS

অভিযান আর জরিমানার জালে বন্দী ক্ষুদ্র খাবার ব্যবসায়ীরা, নীতিমালাহীন অভিযান দৌড়াত্মে নাজেহাল

এইবার রোজায় ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক অভিযান এবং জেল-জরিমানা’র নিউজ প্রতিদিন খবরের কাগজে উঠে আসছে। ম্যাজিস্ট্রেট এবং সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা অভিযান চালাচ্ছে। এটা অবশ্যই সাধুবাদ প্রাপ্য, আমাদের ভোক্তা সংরক্ষণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাদের কর্মপদ্ধতি যথেষ্ট প্রশ্নের উদ্রেক করছে। প্রথমত তাদের যে নীতিমালা অবলম্বন করে তারা এই কার্যসম্পাদন করছেন, সেই নীতিমালা সম্পর্কে কয়জন ব্যবসায়ীকে কোন সরকারী সংস্থা নোটিশ দিয়েছেন, অবগত করেছেন এই এই নীতি অবলম্বন করতে হবে। এই অভিযানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী এবং অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা খাবারের দোকানগুলো। জানি আমার সাথে আপনি একমত হবেন না, তবু কষ্ট করে আমার লেখাটি পড়ে আমার বলা কথাগুলো একটু ভেবে দেখবেন।

প্রথমে আসি, খাদ্য পরিদর্শন দলের কথায়। যে দলটি এসব অভিযান পরিচালনা করছেন সেখানে কতজন রান্না এবং খাদ্য বিশেষজ্ঞ আছেন? আমার নিজ অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। নিউমার্কেট এক নম্বর গেটে যে বিখ্যাত ফাস্টফুড দোকান ছিল “ম্যাগডোনাল্ড” নামে (এখন তা ভাড়ায় অন্য মালিকানায় চলে), তার মালিক আমার খুব কাছের আত্মীয়। ২০০৪/২০০৫ এর ঘটনা, আমি সেদিন একটা ব্যক্তিগত কাজে উনার দোকানে গিয়েছি খুব সকাল বেলা। বেলা এগারোটার দিকে দোকান খুলছে তখন, এমন সময় ম্যাজিস্ট্রেট সদলবলে হাজির অভিযানে। দোকানে এটা ওটা চেক করে একপাশে দেখতে পায় একটা বড় গামলায় মোটা কাপড় দিয়ে ঢাকা কোন মিক্সচার। মজার ব্যাপার ওটা ছিল জিলাপির খামির, যারা জিলাপি তৈরির পদ্ধতি জানেন, তারা জানেন যে, জিলাপির খামির আগের রাতে করে রেখে দেয়া হয় গাঁজনের জন্য। আর বেলা বারোটা থেকে ভাজতে হবে বলে তা আগের রাতেই দোকান মালিকদের করে রাখতে হয়। ম্যাজিস্ট্রেট জিলাপির কারিগরকে জিজ্ঞাসা করল ঐটা কি? সে বলল, খামির। “খামির? এটা কি?”... “স্যার জিলাপির কেমিক্যাল...”!!! ব্যাস আর যায় কোথায়? নগদে দশ হাজার টাকা জরিমানা। আমি দাঁড়ানো সেখানে, আকাশ থেকে পড়লাম। সবাই যতই বুঝাবার চেষ্টা করল, কে শোনে কার কথা। সাথে থাকা পুলিশ ভাইদের হম্বিতম্বিতে মনে হচ্ছিল কোন নিষিদ্ধ মাদক অথবা চোরাচালান উদ্ধার করেছেন। আরও দুঃখের ঘটনা ঘটল একটু পরে, দোকানের ক্যাশে দশ হাজার টাকা নগদ রাখা ছিল না। ফলে দোকানের মালিককে পুলিশ ভ্যানে করে নিয়ে গেল! সাথে সাথে পাশের স্বর্ণের দোকানের মালিক দশহাজার টাকা নিয়ে উনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। এই হচ্ছে বাস্তবতা, একজন রন্ধন বিশেষজ্ঞ কি এই দলে থাকবে না? 

এবার আসি, পুরাতন ঢাকার বোম্বে সুইটস এর চানাচুর নাকি মবিলে ভাঁজা হয়! পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করা হল। মালিক বেচারা কারে কি বলবে? উনার কথা, ‘মবিলে যদি চানাচুর কেউ ভাঁজতে পারে তার দোকান লেইখা দিমু...’ কে শোনে কার কথা? আসল ঘটনা হচ্ছে পোড়া তেল। অনেক আইটেম আছে যা কাঁচা অর্থাৎ নতুন তেল থেকে রান্না করা তথা ভাঁজা যায় না। সেক্ষেত্রে পুরানো তেলের সাথে নতুন তেল মিশিয়ে তাতে ভাঁজা হয়। ফলে প্রতিবারের পুরাতন তেল রেখে দেয়া হয় যা ঘন এবং দেখতে অনেকটা কালো হয়, যা প্রথম দেখাতে মবিল মনে হতে পারে। কিন্তু রান্নার তেল আর মবিলের পার্থক্য করার মত কোন যন্ত্র কি তাদের সাথে থাকবে না? 

এক্ষেত্রে আরকেটা কথা, তেলে ভাঁজা আইটেম যদি প্রতিবার ভাঁজার পর ব্যবহৃত তেল ফেলে দেয়া হত (বিশেষ করে ডুবো তেলে ভাঁজা আইটেম) তাহলে ঐ পণ্যের উৎপাদন খরচ কত হত? আর সেই পণ্যের বিক্রয়মূল্য কত হত? সেই মুল্যে আপনি আমি সেই পণ্য ক্রয় করতে কতটুকু আগ্রহী হতাম?

এই বছর আরেকটা জিনিষ দেখলাম, যেখানে সেখানে ইচ্ছামতন জরিমানা করা। চকবাজারে মাঠা বিক্রেতাকে বিশ হাজার টাকা জরিমানা! আরে ভাই ঐ বেচারাতো দিনে দশ হাজার টাকা বিক্রি পর্যন্ত করে না? তার মূলধন সর্বসাকুল্যে দশ হাজার টাকা হবে কি না সন্দেহ। আপনি বলতে পারেন খারাপ খাবার বিক্রি করছিল, তাই জরিমানা হয়েছে। এবার তাহলে কাজের কথায় আসি। “ল অফ কন্ট্রাক্ট” এ অফার এন্ড এক্সেপটেন্স বলে একটা ব্যাপার আছে। উনারা চকবাজারের খোলা রাস্তায় খোলা অবস্থায় খাবার সাজিয়ে রেখেছেন। এখানে অফার করাই হচ্ছে খাবার এই অবস্থায়, আপনি সেটা কিনছেন সব দেখে শুনে, এটা একসেপ্টেন্স। এখানে ব্রিচ অফ কন্টাক্ট কোথায় হচ্ছে? হ্যাঁ স্বাস্থ্য প্রশ্নে সরকারের ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপার আছে, কিন্তু সেটা প্রতি রমজান এলেই কেন হবে? ঈদের বোনাস আর বেতনে এতো খরচ তাহলে পোষায় না বলে? মজার ব্যাপার একই দিনে চট্টগ্রামে কয়েকশ টন ভেজাল খাবার তেল উদ্ধার করে জরিমানা করা হয়েছে আড়াই লাখ টাকা!!! সত্যি, বিচিত্র এই দেশ...

এবার দেখুন ভালো কিছু রেস্তোরায় জরিমানা করেছে গত পরশু, তালিকায় আছেঃ স্টার কাবাব, মালঞ্চ, ঘরোয়া, অষ্টব্যাঞ্জন। এদের মধ্যে এক রেস্টুরেন্টকে জরিমানা করেছে এক লক্ষ টাকা, কারণ খাবার উন্মুক্ত ছিল, গ্লাভস পরিহিত সেলসম্যান ছিল না আর মূল্য তালিকা ছিল না। রমজানের ইফতার সারা জীবন এভাবেই বিক্রয় হয়ে এসেছে, তাই নয় কি? আচ্ছা একটা প্রশ্ন, রমজানের ইফতার বিক্রির জন্য মূল্য তালিকা কবে থেকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে খুব জানতে মুঞ্চায় ;) । এমন কি সারা বছর সাধারণ মানের সকল খাবারের হোটেলগুলো এভাবেই খাবার বিক্রয় করছে। ঢাকা শহরেই বুঝি লক্ষাধিক এমন খাবার দোকান রয়েছে। তখন এসব তদারকি কোথায় যায়? আরেকটা জিনিশ দেখুন, যখন প্রতিষ্ঠিত খাবার প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো ভেজাল খাবার, বিষাক্ত খাবার বিক্রয় করছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা কি নেয়া হচ্ছে। প্রাণের জুস ১০০% পবিত্র এবং বিশুদ্ধ পানীয়, তাই তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। পাশের দেশে যেখানে ম্যাগি নুডুলস নিষিদ্ধ হচ্ছে, আমাদের এখানে আগ বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে বলা হচ্ছে ম্যাগি নুডুলস সম্পূর্ণ নিরাপদ। হায়রে দুনিয়া, বড়ই আজীব!!!

এখন আসুন মূল কথায়, উন্নত বিশ্বে খাবারের দোকানগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শন করা হয়। তাদের হাইজিন এন্ড সেফটি ট্রেনিং নেয়া লোক থাকে প্রতি রেস্টুরেন্টে, কমপক্ষে সার্টিফিকেটধারী একজন কর্মী সব দোকানে এটাচড থাকে। সরকারের তরফ থেকে একটা গাইডলাইন থাকে খাদ্য পণ্য প্রস্তুত থেকে শুরু করে বিপনন হয়ে বিক্রয় পর্যায় পর্যন্ত। কিন্তু আমাদের এখানে কি আছে? ঐ চকবাজারের রাস্তার উপরের মাঠা, দইবড়া থেকে শুরু করে আলুচপ, কাবাব বিক্রেতা তাদের কি জানানো হয়েছে এভাবে বিক্রয় করা যাবে না। রাস্তাতো সিটি কর্পোরেশনের, সেখানে দোকান বসছে, তাহলে সিটি কর্পোরেশন থেকে একটা গাইড লাইন দেয়া কি জরুরী না? কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই, অভিযানের নামে চাঁদাবাজি স্টাইলে জরিমানা করেই খালাস। নিন্দুকেরা বলেন, পরিদর্শক দল পঞ্চাশ শতাংশ কমিশন পায় মোট জরিমানা থেকে। 

শেষে একটা মজার গল্প দিয়ে শেষ করি, পুরোটা আমার শোনা, নিজের দেখা নয়। জনৈক সেলিব্রেটি পরিদর্শক ঢাকা কলেজ অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হলের ক্যান্টিন পরিদর্শনে গেছেন। হাত ধোঁয়ার পানির মত ডালের গামলার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করলেন “এটা কি?”। ফাজিল টাইপের একটা ছেলে ভিড়ের মাঝ থেকে বলে উঠলো, “এইটা খায়া পাশ কইরা ম্যাজিস্ট্রেট হইছেন, আর এহন কন এইটা কি?” 😜

পরিশিষ্টঃ অনেকে মনে করতে পারেন আমি ভেজাল খাদ্য ব্যবসায়ীদের পক্ষে বলছি। কিন্তু না, আমি বলছি সিস্টেমের কথা। হুট করে রমজান আসলেই যেখানে সেখানে অভিযান চালাবেন, আর ইচ্ছামত জরিমানার টাকা আদায় করবেন এটা কোন সিস্টেম হতে পারে না। সবার আগে খাদ্য সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করুন, সেটা সকল পর্যায়ের খাদ্য ব্যবসায়ীদের জন্য শ্রেণীকরণ করুন, এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী এবং এক্সপার্ট অপিনিয়ন নিয়ে নীতিমালা তৈরি করুন। সেই নীতিমালা যেন বাস্তবসম্মত হয় এবং প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। কাগজে কলমে অনেক কিছুই সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। পুরাতন ঢাকার বিরিয়ানির দোকান (হাজী, নান্না, হানিফ, রয়েল) যাদের গড়ে এক/দুই প্যাকেট প্রতি মিনিটে বিক্রয় করতে হয় সেখানে আপনি গ্লাভস আর খাবার ঢেকে রাখার কথা বলতে পারেন না। তাই বাস্তবসম্মত নীতিমালা হতে হবে। সেই নীতিমালা সকল ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে, তাদের উপযুক্ত সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়মিত রুটিন পরিদর্শন অব্যাহত রাখতে হবে। তারপর না হয় এই রমজানের মত পিক মৌসুমে অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করবেন। আর নাহলে থামেন, এইসব বন্ধ করেন। পারলে নেসলে’র ম্যাগি, প্রাণের জুস এসব সমূলে উৎপাটন করুন, এরকম আরও ভয়ংকর ক্ষতিকারক খাদ্য দ্রব্য প্রস্তুতকারক, আমদানি কারক, বিক্রেতা এদের বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নেন। পচা গম আমদানি করে জনগণকে খাইয়ে দিবেন সেক্ষেত্রে কোথায় থাকে অভিযান। শেষে একটা কথাই বলি, মনে রাখবেন রমজান সংযমের মাস, ইবাদতের মাস, চাঁদাবাজি আর ধান্দাবাজি’র মাস না।

No comments

Powered by Blogger.