Header Ads

Header ADS

নীল ঈদ

আজ শবে কদর, তাহের খুব মনোযোগ দিয়ে আজকের তারাবীর নামাজটুকু পড়ছে, তিলাওয়াতের মধুর সুরটুকু অন্তরের মাঝে গেঁথে নিতে চায় যেন। সারা বছর নামাজ পড়া হয়ই, তবে মাঝে মাঝেই যে ছাড় যায় না, তেমন নয়। আজ খতম তারাবীহ, আবার একবছর পর এই খতম তারাবীহর নামাজ পড়ার সুযোগ আসবে, তাই খুব একাগ্রতার সাথে নামাজে মত্ত ছিল তাহের। হঠাৎ করেই তার পকেটে থাকা মোবাইলটা কাপাকাপি শুরু করে দিল। তাহেরের এই এক বদভ্যাস, ও কখনোই মোবাইল সুইচ অফ করে না। যেখানে একান্তই বাধ্য হয়, সেখানে মোবাইল সেটটাকে সাইলেন্ট উইথ ভাইব্রেশন মোডে দিয়ে রাখে। এখন যুগটাই হল যোগাযোগের, একদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেই দেখা যায় অনেককিছু ঘটে গেছে চোখের আড়ালে। তাই একান্ত বাধ্য না হলে তাহেরের মোবাইল সুইচ অফ হয় না বললেই চলে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সারাদিনে কোন কল বা মেসেজ কিছুই আসেনি এমন দিনেও হঠাৎ মোবাইল বন্ধ করে কোথাও গেল অথবা সুইচ অফ করে বসার ঘরে টেলিভিশন দেখতে বসল, ঘণ্টাখানেক পরে সেট অন করে বা হাতে নিয়ে দেখবে মিসকল এলার্ট এসে ভরে গেছে। 

ঐ রাকাতের সালাম ফেরানো হলে মোবাইল বের করে দেখে ছোট বোনের কয়েকটা মিসকল। মেজাজটা খারাপ হল, আজকের রাতে কি এমন জরুরী কাজ পরে গেল যে, হুট করে এতবার কল দিতে হবে। বদ মেয়েটা জানে যে, তাহের এখন মসজিদে আছে, বাসা থেকে আসার সময় দেখে এসেছে ছোট বোনটা নিজেও নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এই ইবাদত বন্দেগীর মাঝে মোবাইলে কল করার কি দরকার পড়ল খোদা জানে। তাহের একবার ভাবল নিচু স্বরে একটা কল ব্যাক করে দেয় একটা ঝাড়ি, পরে আবার ভাবল, না থাক, বাসায় গিয়ে ধরতে হবে ফাজিলটাকে।

নামাজ শেষ করে বাসার কাছে আসতেই পাশের বাসার কামাল ভাই তাহেরকে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার আম্মা এখন কেমন আছেন?”। তাহের কিছুটা অবাক হল, হঠাৎ করে আম্মার খবর নিচ্ছেন কামাল ভাই! “ভালো” বলে তাহের পা বাড়াতে উদ্যত হলে কামাল ভাই আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “ডাক্তার কি বললেন? কোন হসপিটালে নিলে?” তাহেরের মনে হল সে হঠাৎ করে কোন অভেদ্য গোলক ধাঁধার মাঝে পড়েছে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারলো কেন তার ছোটবোন নামাজের মাঝে বারবার তাকে ফোন দিচ্ছিল। দ্রুত বাসায় ঢুঁকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিষপত্র আর টাকা সাথে নিয়ে রওনা হল হাসপাতালের দিকে। বুক দুরুদুরু করছে, ফোন করে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও ভয় করছে, না জানি কোন খারাপ কিছু শুনতে হয়।

রাত বারোটা, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, মায়ের হার্ট এটাক হয়েছে, অবস্থা খুবই খারাপ। অথচ, মায়ের কোন সমস্যা ছিল না, মাঝে মধ্যে যে বলে নাই, বুকে ব্যাথা করে তেমন না, তবে সেটা দৈবাৎ দু’একবার। তারপরও তাহের কত পীড়াপীড়ি করেছে, ‘চল তোমাকে একটা ফুল চেকআপ করিয়ে নিয়ে আসি।” কিন্তু কে শোনে কার কথা, মা মুখে ঠাট্টা মিশ্রিত হাসি দিয়ে বলত, ‘ইদানীং তোর বুঝি ইনকাম খুব বেড়েছে? টাকাগুলো জমিয়ে রাখ, কয়দিন পর ঘরে বউ আনবো, তখন কাজে লাগবে।’ অথচ, তাহেরের সেই অজানা শঙ্কাই আজ বাস্তব হল, মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। রক্তচাপ ত্রিশের নীচে নেমে গেছে সাথে হাই সুগার। অথচ ব্লাড প্রেশার বা ডায়বেটিকস জাতীয় কোন সমস্যা কখনো মায়ের ছিল না, সুস্থ সবল মা কখন ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলো না। 

সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ফজরের নামাজ পড়ার পর আইসিইউ’র বারান্দার বেঞ্চিতে একটু শুয়েছিল। কোনফাঁকে সকাল হয়ে গেল, লোকজনের আনাগোনা বেড়েছে টের পায় নাই। হঠাৎ কারো হাতের ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে গেল তাহেরের, তার মেজ খালা, তাহেরকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে, তাহেরের বুকে চাপর মেরে কাঁদতে লাগলো বিলাপ করে, ‘তোর মা এখানে মরে মরে অবস্থা, আর তুই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস। সারাবছর নামাজ পড়িস না ঠিকমত, কাল যখন বুবলি এতবার তোকে ফোন করল তুই একবারও ফোনটা ধরলি না। সময়মত আমার বোনটাকে হাসপাতালে আনতে পারলে বাঁচাতে পারতাম...’ তাহের হতভম্ব হয়ে প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে বেঞ্চ হতে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের জামাটা টেনে ঠিক করল। রাতজাগা চোখের নীচে কালি জমা আর উস্কখুস্ক চুলের দিশহারা বছর সাতাশের এক যুবক, রক্তলাল চোখ নিয়ে মাথা নিচু করে অবুঝ আত্মীয়ার প্রলাপ শুনতে লাগলো। একটু পর একজন নার্স এসে সবাইকে আইসিইউ এর কম্পাউন্ডের বাইরে বের করে দিলেন।

কাল রাতে মায়ের অবস্থা দেখে তাহেরের আর সেহেরী খাবার কথা মনে ছিল না। এখন পেটে ক্ষুধার চাপ অনুভব করতে পারছে। একবার ভাবল রোজা ভেঙ্গে ফেলা যাক, পরে মনে হল না খেয়ে তো কতদিন রোজা রেখেছে বাসায়। মা ফজরের আজানের ঠিক আগে আগে বা পরে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলতেন, ‘ওঠ ওঠ, মুখে একটু পানি দিয়ে নে, আজান পরে গেছে’। তাহের তখন বলত, ‘মা, আজান দেয়ার আগেই সেহেরী খাওয়ার সময় শেষ হয়ে যায়, কিচ্ছু খেতে হবে না, না খেয়েই রোজা রাখবো আজ’। মায়ের কথা মনে হতেই চোখ ভিজে উঠলো। ডাক্তার বলেছে দুপুর বারোটায় ফাইনাল রিপোর্ট করবেন, উনারা উনাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। প্রেশার আর সুগার কন্ট্রোলে এলেই হার্টের চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন, অন্যথায় উপায় নেই। ঘড়িতে সময় দেখল, বারোটা প্রায় বাজে। তাহের ধীর পায়ে ডাক্তারদের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করল।

ডাক্তার তাহেরকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন, ‘এই যে ইয়ং ম্যান, এতো মুখ কালো করে রাখার কিছু নেই। গুড নিউজ, তোমার মায়ের ব্লাড প্রেশার এবং সুগার লেভেল দুটোই প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, হার্টের ট্রিটমেন্ট অলরেডি শুরু হয়ে গেছে’। আনন্দে মনে হয় তাহের কেঁদে দিবে, চোখের পানি আর বাঁধ মানছেনা। দ্রুত সে সরে গেল ডাক্তারের কাছ থেকে।

এরপরের দুইদিনে তাহের দেখল আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে তার মা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলেন। যেনতেন সুস্থ নয়, ডাক্তার উনাকে বাসায় নিয়ে যেতে বললেন। কারণ বাসায় প্রপার টেক কেয়ার করা যাবে। কারণ তারপর দিন ঈদ, ঈদের ছুটিতে হাসপাতাল জরুরী ভিত্তিতে খোলা থাকলেও লোকবল থাকে কম, তাই রোগীদের তেমন টেককেয়ার করা সম্ভব হয় না। তারচেয়ে বাসায় থাকুক, সবার সাথে ঈদ করুক, সবার মাঝে থাকুক। শুধু দুটো কথা, উনার রুমে যেন বেশী কথাবার্তা না করা হয় আর সাথে যেন একজন সার্বক্ষণিক আয়া থাকে। তাহেরের মনে হয়েছিল, এই ঈদের চেয়ে ভাল ঈদ তার জীবনে আর কখনো আসেনি, আর কখনো আসবে না। ডাক্তারকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল সে।

ঠিক তার পরের বছর ঈদের দিন বিকেল বেলায় আকস্মিক স্ট্রোক করে মারা যান তাহেরের মা, তাহের তখন বন্ধুদের সাথে শহরেরে কোন এক ক্যাফেতে আড্ডা দিচ্ছে। সামনের মাসেই তার বিয়ে, মায়ের পছন্দের পাত্রীর সাথে। তাই এই ঈদে বন্ধুদের সাথে সপ্তাহভর সময় কাটানোর প্ল্যান। তাই সকালবেলা ঈদের নামাজ পড়ে, মাকে সালাম করে সেমাই-জরদা-পায়েস খেয়ে বেলা এগারোটা নাগাদ বাসা থেকে বের হয়েছে। বিকেল পাঁচটার দিকে ছোট বোন বুবলির ফোন, কোন কথা বলতে পারছে না, শুধু চিৎকার করে “ভাইয়া...” বলে কাঁদছে। দ্রুত বাসার দিকে ছুটে যায় তাহের, সাথে বন্ধুরাও, অজানা কোন আশঙ্কায়। বাসায় এসে দেখে পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে কিছু আত্মীয়স্বজনও এরই মধ্যে চলে এসেছে। বাসায় ঢুঁকে মায়ের লাশের কাছে লুটিয়ে পরে তাহের। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়ে শুধু একটি শব্দ, “মা গো... মা...”

আজও তাহেরে জীবনে ঈদ আসে। স্ত্রী ছেলে মেয়ে সবাইকে নিয়ে তার পরিবারে ঈদ আসে, শুধু তার মনের আঙিনায় ঈদ আর কখনো আসেনি, কখনোই না। কারণ ঈদ মানে তার কাছে বেদনাময় স্মৃতি, নীল বেদনার নীল ঈদ।

No comments

Powered by Blogger.