Header Ads

Header ADS

অজানা সেই মেয়ের অজানা জেদ আর কঠোর পরিশ্রমের গল্প [Never Underestimate Anybody: জীবন থেকে নেয়া একগুচ্ছ প্রেরণার গল্প - ০৭]

ইদানীং যে সকল ঘটনা ঘটছে তার প্রেক্ষিতে প্রায় ভুলে যাওয়া এই মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মেয়েটাকে চিনি না, কিন্তু আমার এক পরিচিতজনের সহপাঠী ছিল অনার্স লেভেলে। সেই মেয়ে সুদূর নারায়ণগঞ্জ থেকে ভোর রাতে রওনা হত ঢাকার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন। নদী পার হয়ে বাসে করে গুলিস্তান, সেখান থেকে বাস পরিবর্তন করে মোহাম্মদপুর। সেখান থেকে রিকশা করে শিয়া মসজিদ এবং সেখান থেকে কিছুটা হেঁটে প্রাইভেট টিউটরের বাসায় সকাল সাতটা’র ব্যাচে পড়তে আসা! কারণ, নয়টা থেকে কলেজ। সঙ্গত কারণে কলেজের নাম উল্লেখ থেকে বিরত রইলাম। এই মেয়ে টানা নয় মাস এই কঠোর পরিশ্রম করে এক অসাধ্যকে সাধন করেছে। 

মেয়েটি আর আট দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ মেয়ের মত। রূপে গড়নে সাধারণ যেমন, মেধা বা রেজাল্টেও তেমন সাধারণই ছিল। কিন্তু কোন এক ব্যক্তিগত অপমানের জের ধরে তার মাঝে এক অসাধ্য সাধন করার জেদ চেপে যায়। যে সময়কার কথা বলছি, তখন তিন বছর মেয়াদী অনার্স ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেয়েটি যখন তৃতীয় বর্ষে উঠলো, তখন আগের দুই বছরের রেজাল্টে সে প্রথম বিভাগ থেকে ত্রিশ নম্বর পিছিয়ে ছিল। সেই অবস্থা থেকে সে জোর প্রতিজ্ঞা করে যে কোন উপায়ে তাকে প্রথম বিভাগ নিয়ে পাশ করতেই হবে। 

পড়ালেখার খরচ যোগাতে সে সন্ধ্যার পর তার নিজ এলাকায় টিউশনি করত। প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়া ছাড়া গত্যন্তর নেই দেখে শুরু হল সেই ভোররাত থেকে মিশন, যা শেষ হত আবার সেই মধ্যরাতে। সন্ধ্যার আগে নারায়ণগঞ্জ ফিরে দুই/তিনটা টিউশনি করে বাসায় ফিরে আবার পড়তে বসা। একদিন দুইদিন নয়, প্রায় প্রতিদিন চলেছে এই রুটিন, টানা দশ মাস।

কিন্তু তার মিশনটা কতটা কঠিন ছিল তা বোঝার জন্য আপনাকে সেই সময়কার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের পড়ালেখার সিস্টেম বুঝতে হবে। আপনি যে বিষয়েই অনার্স করুন না কেন, প্রথম দুই বছরের এক্সামে যতটা পারা যায় বেশী নম্বর তুলে নিতে হতে চূড়ান্ত ফলাফলে প্রথম বিভাগ পেতে হলে। কেননা, এই ফাইনাল ইয়ার তথা থার্ড ইয়ারে এসে মোট পাঁচটা পত্রে পরীক্ষা দিতে হত যেগুলো থাকত পুরো কোর্সের তুলনামূলক কঠিন বিষয়ের। সেই পাঁচ বিষয়ে গড়ে শতকরা ষাট ভাগ নম্বর পাওয়া যেখানে কঠিন ব্যাপার, সেখানে আগের ত্রিশ মার্ক কভার করে প্রথম বিভাগ পেতে হলে তাকে গড়ে পেতে হত শতকরা পঁয়ষট্টি ভাগ নম্বর। 

অবাক করা হলেও সত্য যে, সে ঐ ত্রিশ মার্কই শুধু নয়, সাথে অতিরিক্ত আরও সাত মার্ক কভার করেছিল। অর্থাৎ ফাইনাল ইয়ারে সে শতকরা সাতষট্টি হারে গড়ে নম্বর পেয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত প্রথম দশজনে সে থাকতে পারে নাই দুই/তিন নম্বরের জন্য। কিন্তু এই রেজাল্টের পর তার পুরো জীবনই পাল্টে গিয়েছিল। মাস্টার্সে ভালো রেজাল্ট করে বিসিএস দিয়ে এখন নাকি সে ভালো পদে চাকুরীরত। 

বিশ্বাস করুন, যে মেয়েটাকে কখনো দেখি নাই, যার নাম পর্যন্ত মনে নাই, তার সেই পরিশ্রম আর তার অর্জন মনে করে আজও আমি নিজে নিজেকে অনুপ্রেরণা দেই। খুবই সাদামাটা একটা কাহিনী হয়ত, কিন্তু তার পরিশ্রম লক্ষ্য করুন। প্রতিদিন সেই সুদূর নারায়ণগঞ্জ হতে রওনা হয়ে সকাল সাতটার ব্যাচে মোহাম্মদপুর এসে প্রাইভেট পড়া! আবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে টিউশনি! তার সাথে যোগ করুন হালকা পাতলা গড়নের তরুণী। 

আমার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা জাগে কি ছিল তার এই জেদের পেছনের গল্প সেটা জানতে। কি ছিল সেই ঘটনা, যা তার আটপৌড়ে জীবনে এনে দিয়েছিল এক বিশাল পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা। যে মেয়েটি কখনো স্বপ্ন দেখেনি খুব বড় কিছু করার, হঠাৎ একদিন সেই মেয়ে জেদ করে নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করে বসল ভিন্ন কিছু করার। স্যালুট সেই অজানা, অদেখা সেদিনের সেই তরুণীকে। 

এই সিরিজে শেষ লিখেছিলাম অনেক আগে। আসলে অনুপ্রেরণা সাথে আণ্ডারডগ যাকে বলে আন্ডারএস্টিমেটেড, সেরকম মানুষের সাফল্যের গল্প তো আর বানিয়ে বানিয়ে লেখা যায় না বা রোজ রোজ দেখা যায় না। তবে আমার জীবনে আমি এমন বহুজনের দেখা পেয়েছি, যাদের থেকে তাদের অজান্তেই নিজেকে অনুপ্রেরণা দেই। যখন ভেঙ্গে পড়ি, কোন কারণে খুব অসহায় লাগে নিজেকে তখন এসব মানুষদের কথা মনে করে নিজেক বুঝ দেই। খারাপ সময় যতই খারাপ হোক, তা চিরস্থায়ী নয়। 


অনটপিকঃ প্রথমে যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, ইদানীং আমাদের দুষ্ট ছেলেদের যে দুষ্টুমি চলছে, তাতে সেই মেয়ে এক দশক পরে এই সময়ে জন্মালে কি হত ভেবে দেখুন! ভোররাতে বাসা থেকে বের হওয়া মানে তো বাঘের থাবায় নিজেকে উজাড় করে দেয়া, ফেরা আবার সেই প্রায় সন্ধ্যায়! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।

No comments

Powered by Blogger.