Header Ads

Header ADS

আর দেখা হবে না... "হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল" চলে গেলেন না ফেরার দেশে।


আমার সবচাইতে প্রিয় গায়ক, হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল, আজ পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। প্রিয় মানুষগুলো যেন হাতের মুঠোর ফাঁক গলে সমুদ্রের বুকে মিশে যাচ্ছে। আমি প্রচুর গান শুনতে পছন্দ করা মানুষ, আর আমার গানের নেশা হলো সর্বভুক প্রকৃতির। নব্বইয়ের দশকের ছেলেপেলেদের মতো আমারও শখ ছিলো ফিতার ক্যাসেট এর সংগ্রহশালা। ব্যান্ড এর মধ্যে গ্রেট আইয়ুব বাচ্চু এবং তার “এলআরবি” ছিলো সবচাইতে পছন্দের আর সলো শিল্পীদের মাঝে হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল। আর এতো এতো গায়ক গায়িকা’দের ভীড়ে সবচাইতে পছন্দের জায়গাটা দখল করে ছিলেন জুয়েল ভাই। উনার প্রতিটি এ্যালবাম এর প্রতিটি গানই আমার পছন্দের তালিকায় চলে আসতো। উনার গানের সাথে পরিচয় আমার অনেকটা দেরীতে। উনার “বেশী কিছু নয়” এ্যালবাম এর মাধ্যমে। এরপর একে একে সংগ্রহে আসতে থাকে তার এর আগের সব কয়টা এ্যালবাম – “কুয়াশা প্রহর”, “এক বিকেলে”, “আমার আছে অন্ধকার”, “একটা মানুষ”, “দেখা হবে না”…… এরপর “বেদনা শুধুই বেদনা”……… তার গাওয়া পছন্দের গানের তালিকা কি বিশাল দীর্ঘ… কেননা সব গানই যে খুব পছন্দের। কলেজ ভার্সিটি লাইফের পুরোটা সময়ে প্রতিদিন জুয়েলের গান বাজতো অডিও প্লেয়ারে। কিছু কিছু গান বার বার রিওয়াইন্ড-ফরোয়ার্ড করতে করতে মাঝে মাঝে রেকর্ড এ চাপ পড়ে গানের রেকর্ডিং নষ্ট হয়ে গেছে… আহ কত সুখস্মৃতি, আমৃত্যু জুয়েল ভাইকে আর তার গাওয়া প্রিয়গানগুলোকে ভুলতে পারবো না। আমার মতো আইয়ুব বাচ্চু'র কাছেও খুব প্রিয় ছিলেন হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল; আর তাইতো তার ০৯টি সলো এ্যালবামের মধ্যে ০৭টি'রই সুরকার ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু!

২০১৪-২০১৫ সালের দিকে উনাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুঁজে পেয়ে কানেক্টেড হওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট পাঠালাম, যেদিন উনার এক্সেপ্টেন্স পেলাম, খুশীতে বুড়ো বয়সে যে চিৎকার করেছিলাম তা শুনে সবাই অবাক হয়েছিলো। সেদিন আরটিভি’র প্রোডিউসার শাহরিয়ার ইসলামের বাসায় আমাদের ভ্রমণ বাংলাদেশ এর বন্ধুদের বারবিকিউ পার্টি আর আড্ডার আয়োজন ছিলো। শাহরিয়ার ভাই আমার পাগলামি দেখে ধমকে বললেন, “ধুর মিয়া, এটার জন্য এমন করে চিৎকার করতে হয় নাকি…”। উনাকে কি করে বুঝাই আমার সবচাইতে প্রিয় গায়ক এর কাছে থেকে এটা পাওয়া আমার জন্য অনেক বড় কিছু। তবে উনারও আর দোষ কি, শাহরিয়ার ভাই যে ছিলেন জুয়েল ভাইয়ের উপস্থাপনায় আইয়ুব বাচ্চুর গানের অনুষ্ঠান “আর মিউজিক” এর প্রযোজনায়.... ... .. . 😕। প্রবাসে ছিলেন সেই সময়গুলোতে, মাঝে মাঝে দেশে আসতেন। দুঃখ একটাই জুয়েল ভাইকে লাইভ কনসার্টে কখনো শোনার সুযোগ হয় নাই। তবে আমার আমিতে খুব বেশী মিশে ছিলেন তিনি তার অদ্ভুত সুন্দর গায়কী দিয়ে গাওয়া প্রিয় কতশত গান নিয়ে। 

হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল এর জন্ম বরিশাল জেলার মুলাদিতে ১৯৬৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকার বাবা রেজাউল করিম এবং মা কোহিনুর করিম এর সংসার আলো করে। ব্যাংকার বাবার চাকরির কারণে ছোটবেলায় তাকে থাকতে হয়েছিল দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তার বাবার আপন চাচাতো ভাই ছিলেন বিশিষ্টি সুরকার ও সংগীতশিল্পী শহীদ আলতাফ মাহমুদ। সেখান থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা আর বাবা মায়ের আগ্রহতেই শিল্পী হয়েছিলেন জুয়েল। প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রতিবেশী একজনের কাছে গান শিখেছিলেন আর মঞ্চে প্রথম গান করেছিলেন তখন তিনি পড়েন চতুর্থ শ্রেণিতে, ১৯৭৮-৭৯ এর সময়কার কথা; স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে গাওয়া সেই গানটি ছিলো 'ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি'। বরিশালে থাকা কালে তিনি ঝালকাঠির মনির হোসেন মিন্টু এবং বরিশালের ওস্তাদ নুরুল আমিন চৌধুরী’র কাছে থেকে সঙ্গীতে দীক্ষা নেন। এরপর ১৯৮৬ সালে ঢাকায় চলে আসেন জুয়েল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিকেন্দ্রিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েন। সেখানে তার সাথে পরিচয় হতে থাকে শিল্প সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানান মানুষ আর বিভিন্ন মিডিয়ার সাথে।  আর সেই পথ ধরেই একসময় গানে জড়িয়ে যান তিনি, পরে হয়েছেন নানান অনুষ্ঠানের নির্মাতা, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে উপস্থাপনা, সবখানেই ছিলো তার সরব পদচারনা।

২০১১ সালে জুয়েলের লিভার ক্যানসার ধরা পড়ে যা পরবর্তীতে ফুসফুস এবং হাড়ে সংক্রমিত হয়। দীর্ঘদিন এই ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন দেশ ও বিদেশের চিকিৎসা সহযোগিতায়। গত বছরের অক্টোবর থেকে জুয়েলকে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে রাখা হয়েছিল। অবস্থার খুব অবনতি হয় চলতি মাসে; পরবর্তীতে ২৩ জুলাই রাত থেকে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। মাঝে ২৫ জুলাই খানিক উন্নতির খবর পাওয়া গেলেও আজ সকালে ক্যানসারের কাছে হার মানলেন এই শিল্পী। আজ ৩০ জুলাই, ২০২৪ রোজ মঙ্গলবার সকাল ১১.৫৩ মিনিটে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি মাত্র ৫৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে এক মেয়ে এবং স্ত্রীকে রেখে গিয়েছেন তিনি।

হাসান আবিদুর রেজা জুয়লে ১৯৮৬ সাল থেকে ফ্রিল্যান্সার অডিওভিজুয়ালিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। পরবর্তীতে “ডেভেলপমেন্ট সাপোর্ট কমিউনিকেশন” এ প্রডিউসার কাম ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেন কিছুদিন। ১৯৯০ সালে “ওয়ার্ল্ড ভিউ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন” নামক এনজিও’তে কাজ করেন বেশ কিছুদিন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে দেশের প্রথম বেসরকারী টেলিভিশন “একুশে টিভি”তে ভিজিটিং প্রোডিউসার হিসেবে কাজ করেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত চ্যানেল আই’তে “প্রোডাকশন এন্ড ইভেন্ট” এর প্রধান হিসেবে কাজ করেন। এরপর ২০১২ সাল পর্যন্ত মাছরাঙ্গা টেলিভিশনে “হেড অফ প্রোগ্রাম” হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ফ্রিল্যান্সার পরিচালক হিসেবে ৩০টির বেশী ডকুমেন্টারি নির্মান করেছেন, ক্যামেরাম্যানহিসেবে কাজ করেছেন ৫০টির মত ডকুমেন্টারিতে। তিনি তার কর্মজীবনে ২০,০০০ মিনিট এর বেশী টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেছেন। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত GREENBEE Communications]” প্রতিষ্ঠানে সিইও হিসেবে কর্মরত ছিলেন। 

হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল এর এ্যালবামসমূহ এর তালিকাঃ 

(০১) কুয়াশা প্রহর (১৯৯৩) - সুরকারঃ আইয়ুব বাচ্চু
(০২) এক বিকেলে (১৯৯৪) - সুরকারঃ আইয়ুব বাচ্চু
(০৩) আমার আছে অন্ধকার (১৯৯৫) - সুরকারঃ আইয়ুব বাচ্চু
(০৪) একটা মানুষ (১৯৯৬) - সুরকারঃ আইয়ুব বাচ্চু
(০৫) দেখা হবে না (১৯৯৭) - সুরকারঃ আইয়ুব বাচ্চু
(০৬) বেশী কিছু নয় (১৯৯৮) - সুরকারঃ আইয়ুব বাচ্চু
(০৭) বেদনা শুধুই বেদনা (১৯৯৯) - সুরকারঃ প্রণব ঘোষ
(০৮) ফিরতি পথে (২০০৩) - সুরকারঃ বাপ্পা মজুমদার
(০৯) দরজা খোলা বাড়ি (২০০৯) - সুরকারঃ আইয়ুব বাচ্চু

হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল এর আমার খুব প্রিয় মিক্সড এ্যালবাম পাঁচটি গানঃ
(০১) চোখের ভেতর স্বপ্ন থাকে - এ্যালবামঃ অপেক্ষায় থেকো (বাপ্পা মজুমদার) ডুয়েট (কনকচাঁপা)
(০২) আমি অবাক হয়ে যাই - এ্যালবামঃ তুমিহীনা সারাবেলা (আইয়ুব বাচ্চু)
(০৩) সামনে তোমার চাঁদের পাহাড় - এ্যালবামঃ একই শহরে  (বাপ্পা মজুমদার) 
(০৪) যদি কখনো অসহায় - এ্যালবামঃ ভালবাসতে হবে (প্রিন্স মাহমুদ)
(০৫) তোমার কাছে পুতুল খেলা - এ্যালবামঃ হারজিৎ (প্রিন্স মাহমুদ)

তার দীর্ঘ কর্মজীবন এবং তার সম্পর্কে জানতে আর তার হৃদয়ছোঁয়া গানগুলো শুনতে ভিজিট করতে পারেন তার ব্যক্তিগত ওয়েব সাইটঃ Hassan Abidur Reja Jewel - Official

No comments

Powered by Blogger.