Header Ads

Header ADS

মানসিক একাকীত্ব'র চরম পরিণতি

০৬ বছর পরে; আজকের সমাজে মানসিক একাকীত্ব আরও বেড়েছে বৈ কমে নাই। দেশ, সমাজ, পাত্র ভেদে এই মানসিক একাকীত্ব'র অসহ্য যন্ত্রণা কেউ সইতে পারে, কেউ হয়তো পারে না। আজ ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত এর আত্মহত্যা'র ঘটনায় মনে পড়ে গেল অর্ধযুগ আগে এই ঢাকা শহরের বুকে অতি সাধারন অবিখ্যাত অসফল এক যুবা'র রেললাইন এ শুয়ে আত্মহনন এর ঘটনাটি। এনিয়ে সেসময়কার একটি পোস্ট আবার শেয়ার করা যাক:

মাহবুব রেল লাইনে শুয়ে শুয়ে যে স্ট্যাটাসটি লিখেছিলেন তা ছিল এরূপ, “বন্ধুরা, আমি এমন একটা অপরাধ করতে যাচ্ছি যা আমার পরিবার, আইন ও ধর্মের বিরুদ্ধে। আমি রেল লাইনের ওপর শুয়ে আছি, ট্রেন আসছে... ... বিদায়, বিদায় চিরতরে। মহান আল্লাহ্‌ তোমাদের সবার মঙ্গল করুণ”।

এইতো কিছুদিন আগে, একটা গল্প লিখলাম, "অ্যা সুসাইড নোট", অনেকটা সিনেমাটিক। কিন্তু পুরো ঘটনা আমার শৈশবে দেখা এক ঘটনা থেকে নেয়া। গত পরশুদিন রাতে, আমার ছোট ভাই অফিস থেকে বাসায় এসে আমাকে একটা অনলাইন নিউজ পোর্টালে একটা নিউজ দেখালো। ইতোমধ্যে আপনারা সবাই হয়ত নিউজটা জেনেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ২০১২ সালে “ভূগোল ও পরিবেশ” বিভাগ হতে মাস্টার্স  শেষ করা ছাত্র মাহবুব শাহীন রেললাইনে চলন্ত ট্রেনের নীচে নিজ দেহ বিলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। 

ছেলেটি পুরো সিনেমাটিক স্টাইলে আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু কথা হচ্ছে একজন সম্ভাবনাময় তরুন যুবা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। ছেলেটি এইচএসসি’তে আমার ছোট ভাইয়ের সাথে ঢাকা কলেজের স্টুডেন্ট ছিল। ফেসবুকে ও আরও অনেকের মত সে ও আমার ছোট ভাইয়ের ফ্রেন্ডলিস্টে ছিল। ফেসবুকে তার স্ট্যাটাস আমার ভাইও দেখেছিল। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে পারে নাই সে সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। 

খবরটা শুনেই আমার কান্না চলে আসলো, ছোট ভাই এর সামনে কাঁদতেও পারছিলাম না। উফ কেন  এমন হয়। মাহবুব তার এই আত্মহত্যা’র সিদ্ধান্ত নেয়ার কারন ব্যাখ্যা করেছেন তার স্ট্যাটাসে, “এই হতচ্ছাড়া নিজেকে দূরে সরিয়ে দিতে যাচ্ছে, যে অপদার্থ কি না শুধু খেতেই জানে। আমি একটা কমেন্টে লিখেছিলাম, আমার যেতে হবে। তারপর তোমাদের কেউ একজন জানতে চেয়েছে, কোথায় থেকে কোথায় যাচ্ছ? আমি জানি না আমি কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু আমি যাচ্ছি। এই অকর্মা নিজেকে ছেড়ে যাচ্ছে।”

উফ কি কষ্ট! একটা ছেলের বুকের এই আর্তনাদ কি তার আশেপাশে থাকা কেউ একজনও শুনতে পায় নাই। ছেলেটি কি প্রচণ্ড কষ্ট আর অভিমান থেকে সুসাইড নোটে লিখেছে, “ঐ টাকা যেন আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে তার লাশ দাফনের জন্য ব্যয় করা হয়”। মাহবুবরা কেন এমন করে চলে যায়। যে ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে, যে ছেলে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি টুরিস্ট সোসাইটি’র দুবার সহসভাপতি ছিল, এমন প্রাণোচ্ছল একটি ছেলে কি একদিনের হঠাৎ ক্ষোভ, ক্লান্তি, গ্লানি, অভিমান থেকে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে? অবশ্যই না। কি পরিমাণ অপমান, হেনস্তা এবং পরাজিত হলে এমন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় ভেবে দেখবেন কি?

আমার খুব কাছের এক আত্মীয় আত্মহত্যা করেছিল মাত্র ২০ বছর বয়সে। আমি তাকে ক্লাস এইটে থাকাকালে প্রাইভেট পড়িয়েছি প্রায় এক বছর। ছেলেটা  আর দশটা অন্যান্য ছেলেদের মত স্বাভাবিক ছিল না, কিন্তু অস্বাভাবিকও ছিল না। সে একটু আলাদা, একরোখা, জেদী, বেয়ারা টাইপের ছিল। তার মা তাকে প্রচুর মারত, কথা শোনাত, আমি নিজে মাঝে মাঝে উনাকে আটকাতাম। তো সে ছেলে স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বড় হওয়ার সময়টায় কি হয়েছিল কেউ জানে না। একদিন বিকেল বেলা সবার সাথে নাশতা করে সে তার রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। রাতে খাবার সময় তাকে ডাকতে গেলে কোন সারা না পেয়ে জানালা দিয়ে দেখলে দেখতে পায় পাখার সাথে দড়িতে ঝুলে আছে। উফ কি কষ্ট!

আমাদের সমাজে একটি কমন ঘটনা আছে, কেউ আত্মহত্যা করলে প্রথমেই আলোচনায় আসে ছেলেটি  অথবা মেয়েটি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এ কাজ করেছে। কিন্তু আজ মাহবুব এর মত ঘটনাগুলো সামনে আসছে। অপার সম্ভাবনাময় একটি তাজা প্রাণ ঝরে গেল। কিন্তু কেন? আগে শুনতাম পশ্চিমা বিশ্বে অনেক আত্মহত্যা হয়। এখন আমাদের সমাজে হচ্ছে। কারণ সামাজিক বন্ধনগুলো ঢিলে হয়ে গেছে। 

জিপিএ ফাইভ, গোল্ডেন এ প্লাস, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিবিএ-এমবিএ। স্মার্ট ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, আইপড। গার্ল ফ্রেন্ড, গাড়ী, ৩৬০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটবাড়ী। হাই সেলারি, মানিব্যাগ ভারী। আপনি খুশী, সবাই খুশী। এই রেসে আপনি হেরে গেলেন তো সবই গেল। এই যান্ত্রিক জীবনের ছুটে চলায় হাত ফস্কালেই সব শেষ! পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সবার কাছে আপনি হয়ে যাবেন হেরে যাওয়া একজন। ছোটবেলা থেকে আমাদের শুনতে হয় উমুকের ছেলেমেয়ে এটা করেছে, তুমি কি কর? হ্যাঁ, আমি একজন ফেইলর। কিন্তু সবাইকে জিততে হবে কেন? হেরে যাওয়াদের কেন জায়গা হবে না? সমাজে নয়, আপনজনদের হৃদয়ের মনি কোঠায়?

আমার এক ফ্রেন্ড, যে গ্রাজুয়েশন শেষে ক্যারিয়ার নিয়ে দিশেহারা, প্রচণ্ড মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও কোন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেয়ে গ্রাজুয়েশন করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সে যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, তখন তার ব্রেইন টিউমার বা এই জাতীয় একটা সমস্যা হয়। বাসায় কাউকে জানায় নাই, জানাবে কীভাবে? বাসা থেকে প্রতিদিন শুনতে হয়, ‘এতো বড় ধাড়ী ছেলে, হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে সারাদিন। নিকম্মা কোথাকার”! কি নিষ্ঠুর আমরা! আরেকজনের কথা জানি, মাস্টার্স পাশ করে কোথাও চাকুরী না পেয়ে এক অফিসে পিয়নের চাকরি করত। বাসায় বলত একাউণ্টেণ্ট! কি করবে সমাজ সংসার যে হেরে যাওয়াদের মেনে নেয় না। আমি আমার কোন এক লেখায় আমার এক স্টুডেন্ট এর কথা লিখছিলাম, যে কিনা এসএসসি’র রেজাল্টের আগে দড়ি এবং বিষ যোগাড় করে রেখেছিল। কি প্রচণ্ড পারিবারিক এবং সামাজিক চাপ থাকলে একটা কিশোর বা কিশোরী এই কাজ করতে পারে একবার চিন্তা করে দেখেছেন কি?

আমার এই লেখা পরে নিশ্চয়ই আপনি বিরক্ত হচ্ছেন? যারা আত্মহত্যা করছে তাদের দোষারোপ  করছেন? কিন্তু একবার ভেবে দেখুন মানসিক চাপ যখন মৃত্যুর চেয়ে তীব্রতর হয়ে যায় তখনি একজন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটা আমার কথা না, মনোবিজ্ঞানের কথা। একটি মানুষ যখন আগত দিনে তার জন্য অপেক্ষমান একটিও সম্ভাবনার দুয়ার খোলা দেখতে পায় না তখনই সে এই সিদ্ধান্ত নেয়। হয়ত সবাই পারে না, কেউ কেউ বেঁচে থেকে প্রতিদিন মরে। 

আমি আজ যে কথাটি বলতে চাই, দয়া করে আপনার কাছের মানুষগুলোর সাথে আন্তরিকাতা বৃদ্ধি করেন। প্রতিটি মানুষেরই একটি নির্ভরতার জায়গা থাকতে হয়, যেখানে সে সব কিছু শেয়ার করতে পারে। আপনি, আমি কেন আমাদের আপনজনদের সেই নির্ভরতার জায়গা হতে পারবো না। সেই নির্ভরতার জায়গা, যে জায়গায় হতে মাহবুবদের মত মানুষগুলোকে বুকে জড়িয়ে আশ্বাস দেয়া হবে, ভরসা দেয়া হবে, নাথিং টু লুজ। কেননা, ‘... বল সব মানুষ কি পারে? কেউ জেতে, কেউতো হারে...’। 

আজ থেকে আমরা প্রতিজ্ঞা করি, আমার আশেপাশের প্রতিটি কাছের মানুষকে আরও আন্তরিকতার সাথে আপন করে নিব। যাতে করে সে তার মনে যে কোন কষ্ট-বেদনা, পাওয়া-না পাওয়ার কথা অকপটে শেয়ার করতে পারবে। মাহবুবের স্ট্যাটাস পড়ার পর কেউ যদি তাকে কাউন্সেলিং করতে পারত, হয়ত মাহবুব বেঁচে যেত। হয়ত আমার সেই আত্মীয় ছেলেটি বেঁচে যেত। আজকের সমাজে আমরা কেউ কাউকে ভরসা করতে পারি না, আপন ভেবে মনের সব কথা উজাড় করে বলতে পারি না। এমন কি আপন মা-বাবা, ভাইবোন কে না। স্ত্রী-সন্তানকে না। খুব কাছের বন্ধুটিকে পর্যন্ত না। তাই আসুন আমাদের কাছের মানুষটাকে আরেকটু জানি, আরেকটু কেয়ারিং এন্ড শেয়ারিং বৃদ্ধি করি; যাতে করে আর কোন মাহবুবকে একবুক কষ্ট নিয়ে চলে যেতে না হয় এই পৃথিবী থেকে। আপনার একটু হাসিমুখে কথা অথবা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া, একটু মানসিক সাপোর্ট, একটু ভরসা দেয়া হয়ত আপনারই কাছের প্রিয় মানুষটিকে এই অপ্রিয় সিদ্ধান্ত হতে বাঁচাতে পারে। আর তাই আসুন বিশ্বাস করতে শিখি যে, আমরাই পারি আত্মহত্যা বন্ধ করতে। ইয়েস, উই ক্যান স্টপ সুসাইড।

এই লাইনগুলো যখন লিখছি, চোখে অশ্রুফোঁটারা উকিঝুকি দিচ্ছে। কাকতালীয় হলেও সত্য আমার কম্পিউটারের অডিও প্লেয়ারের প্লেলিস্টে এখন বাজছে, “একদিন, পাখি উড়ে... ... যাবে যে আকাশে... ফিরবে না সেতো আর...”।

No comments

Powered by Blogger.