Header Ads

Header ADS

ঢাকার আঁতুড়ঘর এর শেকড়ের গভীরে - পুরাতন ঢাকার ঘিঞ্জি রাস্তাঘাট এর পেছনের গল্প।



“পুরাতন ঢাকা” শব্দটি শুনলে প্রথমেই চোখে ভেসে আসে ঘিঞ্জি অলিগলি’র একটা জনপদ, যেখানে পদে পদে খাবারের দোকান আর অধিবাসীদের মুখে হাস্যকর “ঢাকাইয়া ভাষা”র গালিগালাজ সম্বলিত কথাবার্তা।এর কতটুকু সত্য? আর যদিওবা তা হয়, তাহলে কিভাবে এই পুরাতন ঢাকার আজকের পরিবেশ গড়ে উঠেছে? প্রশ্ন কি জাগে মনে? এর জন্য আমাদের জানতে হবে কিছু ইতিহাস এবং তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যার হাত ধরে সময়ের সাথে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে আজকের পুরাতন ঢাকা। তাই পুরাতন ঢাকাকে জানতে হলে, পুরাতন ঢাকার এই জনপদ, জীবনাচারের শেকড়ের গভীরে ঢুকে একটু দেখে আসতে হবে যে, কি কারনে সেখানকার জীবনাচার এরকমটা হল। ইচ্ছে আছে পৃথক পৃথক'ভাবে পুরাতন ঢাকার অধিবাসী, রাস্তাঘাট, ভাষা, খাবার, উৎসব, আচার অনুষ্ঠান নিয়ে লেখার। আজকে মূলত আলোকপাত করবো “পুরাতন ঢাকার রাস্তাঘাট” নিয়ে। প্রথমেই পাঠককে মনে রাখতে হবে, পুরাতন ঢাকার ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে কিন্তু জড়িয়ে আছে সমগ্র ঢাকারই ইতিহাস। কেননা, পঞ্চাশ বছর আগ পর্যন্ত ঢাকার বিস্তৃতি মানেই ছিল পুরাতন ঢাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক জনপদ। 

আজকের দিনে সবাই একবাক্যে মেনে নিয়েছেন যে, ঢাকা শহর একটি অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা শহর, যা সময়ের সাথে সাথে কোন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠেছে। আর এই পরিকল্পনাবিহীন শহরের সর্বত্র যানজট এতটাই তীব্র হয়েছে যে, ঢাকা শহরে পরিবহণের গড় গতিবেগ ঘন্টায় ছয় কিলোমিটারের নীচে নেমে এসেছে। এর মূল কারন পরিকল্পনাহীন রাস্তাঘাটের সাথে অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের ভীড়। আর এই অপরিকল্পনার প্রথম শিকার এবং সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী কিন্তু হয়েছে পুরাতন ঢাকা এবং এর অধিবাসীরা'ই। কিভাবে? আসুন একটু বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়া যাক। 

একটি অপরিকল্পিত শহর একদিনে গড়ে ওঠে না| এই ঢাকা শহর ত্রুটিপূর্ণ এবং পরিকল্পনাহীন ভাবে কয়েক শত বছর ধরে গড়ে উঠেছে| এর শুরুর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, সুবেদার ইসলাম খান চিশতি (মুঘল সম্রাট আকবরের আধ্যাত্মিক গুরু, শেখ সেলিম চিশতির নাতি) ঢাকার ভৌগলিক গুরুত্বকে বিবেচনায় রেখে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে বেঁছে নিয়েছিলেন সেই ১৬১০ সালে। কিন্তু কেন তিনি ঢাকাকে বাংলার রাজধানী হিসেবে বেঁছে নিয়েছিলেন? কারন, ঢাকা বৃহত্তর পূর্ববঙ্গের অঞ্চলগুলোর মধ্যে জল-স্থল বিস্তৃতির বিবেচনায় কেন্দ্রীয় অঞ্চল ছিল। একদিকে ঢাকাকে কেন্দ্র করে থাকা দুর্গসমূহ দক্ষিণের আরাকানি মগ এবং পুর্তগিজ জলদস্যুদের আক্রমন হতে সমগ্র পূর্ববঙ্গকে যেমন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল, তেমনি অন্যদিকে নদীভিত্তিক ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারনে সেই সময়ে ঢাকার বানিজ্যিক গুরুত্ব ছিল অনেক বেশী। আর তাইতো ইসলাম খান থেকে শুরু করে শায়েস্তা খান, সকল প্রশাসকেরা ঢাকাকে বেঁছে নিয়েছিলেন রাজধানী হিসেবে। কিন্তু সেই নদীকেন্দ্রিকতার কারনেই ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীন পথঘাটের তেমন উন্নয়নের প্রয়োজন পড়ে নাই। কারন সেই সময়ে ভারী যানবাহনের কোন চলাচল এর প্রয়োজন ছিল না শহরের ভেতর দিয়ে। আর তাই হয়তো ইসলাম খানের ঢাকা আগমনের ৭০ বছর পর ১৬৭৮ সালে, আওরঙ্গজেবের পুত্র মোহাম্মদ আজমের শাসনামলে ঢাকায় প্রথম পাকা রাস্তা নির্মিত হয়েছিল। ইংরেজ আগমনের আগ পর্যন্ত ঠিকই ঢাকার গুরুত্ব ছিল মুঘল সম্রাজ্যের কাছে, কিন্তু সেই নদীপথই ছিল যোগাযোগের মুখ্য পথ। আর তাই তো, মুঘল শাসকেরা ঢাকায় নানান স্বতন্ত্র প্রাসাদ, দুর্গ, বাগান, মসজিদ প্রভৃতি তৈরীতে মনোযোগী হলেও উদাসীন ছিলেন এর সড়কপথ উন্নয়নে। এর সাথে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এবং তৎকালীন সামাজিক অবকাঠামোয় নগরজীবনকে বিবেচনা করা হত নৈতিক অবক্ষয়ের সূতিকাগার হিসেবে। আর এসবের যৌথ ফলাফল হিসেবে কোতয়াল এবং পঞ্চায়েত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় ঢাকার সামগ্রিক কোন নগরায়নের দর্শন গড়ে ওঠে নাই ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত। 

এরপর এল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক শাসন আমল। কোলকাতা হল ইংরেজদের পূর্ববঙ্গ’র কেন্দ্রস্থল। ফলে ঢাকার নগরায়নের বিকাশের যে সুযোগ ছিল তাও শেষ হয়ে যায়। ঔপনিবেশিক আমলে ঢাকাকে বিবেচনা করা হয়েছিল অনগ্রসর কৃষিভিত্তিক একটি জনপদ, যার পুরোটাই অতিরিক্ত খালবিল আর নিম্নজলাভূমি বেষ্টিত একটি অস্বাস্থ্যকর এলাকা। তাই ইংরেজ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশের সমগ্র অর্থনীতি এবং ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে ওঠে সমুদ্রনগরী তৎকালীন বোম্বে এবং মাদ্রাজ (আজকের মুম্বাই এবং চেন্নাই)’কে ঘিরে। যার সাথে পূর্ববঙ্গের সংযোগস্থল ছিল সমুদ্র নিকটবর্তী হুগলি নদীর প্রান্তিক শহর কোলকাতা। আর এর ফলস্বরূপ ১৭৬৫ এর পর থেকে আরও পেছাতে থাকে ঢাকার নগরায়ন। 

আর এই বৈষম্যমূলক উন্নয়নধারায় ঢাকা একটি পিছিয়ে পরা জনপদে পরিণত হতে থাকে। চার্লস ডয়লী কিংবা জর্জ চিনারির ছবিগুলোতে সমকালীন ঢাকার যে চিত্র ফুটে উঠেছিল, তা ছিল একটি পরিত্যক্ত শহর ঢাকা, যেখানে রয়েছে পুরাতন কেল্লা, কাটারা, মসজিদের সাথে জলা-জংগলে ভরা এক অস্বাস্থ্যকর জনপদ। প্রায় শত বছর পর ১৮৬৪ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পরপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন সুসংহত হলে পরে ঢাকায় মিউনিসিপাল কর্পোরেশন এর যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু তা কাগজে কলমেই শুধু রয়ে যায়, কাঙ্ক্ষিত কোন নগর উন্নয়ন সেই সময়ে দেখা যায় নাই। আর তাই তো ধীর গতির নগরায়ন সুবিধা যুক্ত হতে থাকে ঢাকা শহরে। ১৮৬৪ সালে বাকল্যান্ড বাঁধ, ১৮৭৮ সালে জলসরবরাহ প্রকল্প, ১৮৮২ সালে টেলিফোন সংযোগ, ১৮৮৫ সালে রেলগাড়ি যুক্ত হয় ঢাকা নগরীর ইতিহাসে। ১৮৮৫ সালে প্রথম পরিকল্পিত মহল্লা হিসেবে ওয়ারী গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ রাজের অধীনে কর্মরত কর্মচারীদের আবাসনের লক্ষ্যে। 

পরবর্তীতে স্বল্পস্থায়ী বঙ্গভঙ্গের সময়কালে ১৯০৫ হতে ১৯১১ সাল ব্যাপী পূর্ববঙ্গ এবং আসামের রাজধানী ঢাকা হওয়ায় ঢাকা নগরে কিছুটা নগরায়নের উন্নয়ন ঘটেছিল। কিন্তু সেই স্বল্প সময়ে আর কতটুকুই বা হয়েছিল? বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের সময় হতে এই ভারতবর্ষের নগরায়নের কেন্দ্রভূমি ছিল নয়াদিল্লি। ঔপনিবেশিক স্থপতি এডুইন লাতিন্স আর হার্বার্ট বেয়ার এর মহা পরিকল্পনায় নতুন রাজধানী দিল্লিকে কেন্দ্র করে সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা পরিচালনা হতে থাকে; ফলে সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও আধুনিক নগর হিসেবে ঢাকার উঠে আসা আর হয়ে উঠে নাই। যার জের প্রায় এক শতক পরেও আজ পর্যন্ত বয়ে চলেছে প্রাণপ্রিয় ঢাকা নগরী। আর এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হল পুরাতন ঢাকার জনপদ। অথচ ঢাকা শহরের সবচাইতে পরিকল্পিত এবং প্রাচীনতম রাস্তাঘাট এবং নগরব্যবস্থা নিয়ে পুরাতন ঢাকার আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। 

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান আমলে ঢাকা ফের কেন্দ্রিয় গুরুত্বে উঠে আসে। এর ফলস্বরূপ পাকিস্তান আমলে ঢাকার জনসংখ্যা দ্রুত হারে বাড়তে থাকে, এর সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে গৃহায়ণের চাহিদা। এর সাথে তেজগাঁও কেন্দ্রিক গড়ে উঠতে থাকা শিল্পাঞ্চলের প্রসার। এই দুইয়ের কারনে সৃষ্ট আবাসন ঘাটতি মেটাতে, বুড়িগঙ্গাকে একপাশে রেখে দক্ষিণ হতে ঢাকা সম্প্রসারিত হতে থাকে উত্তর দিকে। এর ফলে ঔপনিবেশিক আমলে ঢাকার অভিজাত এলাকা ওয়ারী, গেন্ডারিয়া, পুরানা পল্টন আভিজাত্য হারাতে থাকে। উত্তরে গড়ে ওঠা জনপদ প্রতিনয়ত পরিকল্পনা মাফিক আগাতে থাকলেও কোন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার আওতায় আসে নাই পুরাতন ঢাকার বৃহৎ জনপদ। এই একপাক্ষিক উন্নয়নের জোয়ারে প্রশাসনিক এবং ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র ক্রমশ বুড়িগঙ্গা তীরবর্তি অঞ্চল হতে উত্তরমুখী সরতে থাকে। 

একটি শহরের রাস্তাঘাটের বিকাশের পেছনে মূল দাবিদার এই শহরে চলমান যানবাহন। যানবাহনের উপর নির্ভর করে রাস্তাঘাটের বিস্তার এবং উন্নয়ন। যেমন মনে করেন, আপনার একটি প্রাইভেট কার আছে এবং আপনি একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করতে মনস্থির করেছেন। এখন আপনি নিশ্চয়ই এমন কোন ফ্ল্যাট পছন্দ করবেন না যা একটি সরু গলির ভেতর অবস্থিত কোন বিল্ডিং এ রয়েছে, যেখানে নেই উপযুক্ত পার্কিং সুবিধা। কিন্তু আপনার যদি প্রাইভেট কার না থাকে, তাহলে কিন্তু এই চওড়া রাস্তা আর কারপার্কিং এর ভাবনা মাথায় থাকবে না ফ্ল্যাট ক্রয় করার সময়। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি সুদূরপ্রসারী চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে ভবিষ্যৎ এর চাহিদা হিসেবে প্রাইভেট কার এর কথা মাথায় রাখবেন। সমস্যার শুরু এখানেই। 

তৎকালীন নগর পরিকল্পনাবিদেরা পুরাতন ঢাকার এই ভবিষ্যতের কথা নিয়ে চিন্তাই করেন নাই। তাই তৎকালীন বিদ্যমান যানবাহন মাথায় রেখেই পুরাতন রাস্তার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়েছিল। ঢাকা শহরের গণপরিবহনের দিকে ইতিহাসের পাতায় উঁকি দিলে সর্বপ্রথম নাম আসবে ঘোড়া গাড়ীর। ১৮৩০ সালে সর্বপ্রথম ঢাকা শহরে ঘোড়া গাড়ী চলাচলের কথা ইতিহাস হতে জানা যায়। যদিও ১৭৯০ সালের দিকেই সারা বঙ্গদেশে মাত্র ১০ জন ঘোড়া গাড়ির নির্মাতার তথ্য পাওয়া যায়। সর্বপ্রথম ইংরেজ শাসকেরা এই ঘোড়া গাড়ী ব্যবহার শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে সমাজের সামর্থ্যবান নাগরিকেরাও এর ব্যবহার শুরু করেন। আর্মেনীয়রা আঠারো এবং উনিশ শতকের শুরুর দিকে ঢাকায় বসবাসকারী প্রভাবশালী সম্প্রদায় ছিল। শাঁখারীবাজারের “সিরকো এন্ড সন্স” ছিল এরকম এক আর্মেনীয় পরিবারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যারা বিভিন্ন ইউরোপীয় জিনিসপত্র বিক্রয় করতো। ইতিহাস মতে, ১৮৫৬ সালে এই সিরকোই সর্বপ্রথম ঢাকায় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হিসেবে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন করে যা “ঠিকা গাড়ী” নামে পরিচিত ছিল। এর মাঝেই ঢাকা শহরে আগমন ঘটে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার। ১৮৮৫ সাল নাগাদ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ এবং ১৮৮৬ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ এর মাঝে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। 

ফলে ঢাকা শহরের আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ অবকাঠামোতে তেমন কোন উন্নয়ন হয় নাই, যেমনটা হয়েছিল বহিঃযোগাযোগ এর ক্ষেত্রে। ঘোড়া গাড়ীর পরপরই আসবে রিকশার নাম। বাংলাপিডিয়ায় সিরাজুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন ১৯১৯ সালে তৎকালীন বার্মা থেকে সর্বপ্রথম ঢাকায় রিকশার আগমন ঘটে, যার কোন উপযুক্ত তথ্য সূত্র পাওয়া যায় নাই। আরেকটি সূত্র মোতাবেক এদেশে সর্বপ্রথম নারায়ণগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাট ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কলকাতা থেকে সর্বপ্রথম এই দেশে রিকশার আগমন ঘটান। যাই হোক, মোটামুটি ১৯৩০ দশকে ঢাকায় রিকশার উপস্থিতি প্রমাণিত। ১৯৪১ সালে ঢাকা শহরে রিকশা ছিল ৩৭টি যা ১৯৪৭ সালে এসে ১৮১ তে দাঁড়ায় (এব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণিত তথ্য পাওয়া যায় না যদিও)। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে রিকশার চাহিদা ঢাকা শহরের অধিবাসীদের মাঝে। 

ঢাকা শহরে প্রথম মোটর গাড়ী দেখা যাওয়ার ইতিহাস হল, ১৯০৪ সাল নাগাদ। ১৮৯৮ সালে এইচ এইচ রেনল্ডস সর্বপ্রথম বোম্বে থেকে কলকাতায় মোটর গাড়ী নিয়ে আসেন। ধারনা করা হয়ে থাকে, ১৯০৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন সস্ত্রীক কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন, তখন তাদের আগমন উপলক্ষ্যে চারটি গাড়ীর ঢাকায় অবস্থান করার কথা জানা যায়, স্যার সলিমুল্লাহর মালিকানায়। ধারণা করা হয়ে থাকে, সেগুলোই ছিল ঢাকায় চলাচলকারী প্রথম গাড়ী। বিংশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে ঢাকা শহরে অভিজাত লোকদের ব্যক্তিগত মোটরগাড়ীর কথা জানা যায়। প্রায় সেই সময়ই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে প্রথম বাস সার্ভিস শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে ঢাকা-কালিয়াকৈর, ঢাকা-নয়ারহাট, ঢাকা-মিরপুর, ঢাকা-ডেমরা রুটেও বাস চলাচল শুরু করে বেসরকারী মালিকানায়। প্রায় সমসাময়িক সময় হতেই শুরু হয়েছিল ‘অটোরিকশা’ চলাচল যা আগে “বেবীট্যাক্সি” নামে অধিক পরিচিত ছিল। 

১৯৫৯ সালে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন যা বর্তমানে বিআরটিসি নামে পরিচিত, গঠিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে ঢাকা শহরের পরিবহণ ব্যবস্থা ব্যাপ্তি পেতে থাকে অপরিকল্পিতভাবে। আপনারা হয়ত ভাবছেন, এইসবের সাথে পুরাতন ঢাকার ঘিঞ্জি অলিগলি, রাস্তার কি সম্পর্ক? আছে, আছে... একটু বিস্তারিত আলোচনা দরকার এখানে। রিকশা, টমটম যখন পরিবহণ হিসেবে এল, সেগুলো পুরাতন ঢাকার ভেতরে চলাচলের জন্য সেগুলোর উপযোগী করে রাস্তাঘাট নির্মিত হল। ধোলাইখাল, সুত্রাপুর হতে দক্ষিণের চকবাজার, লালবাগ পেড়িয়ে একেবারে রায়েরবাজার অবধি, এই রাস্তাঘাটগুলো ভাল করে খেয়াল করলে দেখবেন সংখ্যায় কম ঘোড়া গাড়ী আর রিকশা চলাচলের জন্য যথেষ্ট উপযোগী ছিল তৎকালীন সময়েই। পরবর্তীতে বর্ধিত ঢাকা শহর যখন উত্তরে তার শাখা মেলতে থাকলো তখনো এই রাস্তাগুলোতে যানবাহনের চাপ ছিল না কোন। 

তাইতো, আহসান মঞ্জিল হতে বের হয়ে সদরঘাট, লক্ষীবাজার, ধুপখোলা হয়ে নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা মুখী রাস্তাগুলো দক্ষিণ-পশ্চিমের রাস্তাগুলো অপেক্ষা প্রসস্ত ছিল। অন্যদিকে পুরাতন ঢাকার সীমানা পঞ্চাশের দশকেও আজিমপুর হয়ে নিউমার্কেট অবধি বিস্তৃতি পেয়েছিল। ফলে সেই সময় এই সীমানা এলাকা হতে মিরপুর, নয়ার হাট, টঙ্গী বা ডেমরা অভিমুখে বাস-গাড়ী চলাচল উপযোগী প্রসস্ত রাস্তা গড়ে উঠলেও পুরাতন ঢাকার অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট চওড়া করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নাই, হয়ত তখন এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় নাই। কিন্তু সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ছিল না নগর পরিকল্পনাবিদদের মাঝেও। তাই তো সেই শত বছর আগের যান চলাচল উপযোগী রাস্তাঘাট নিয়েই এগিয়ে গেছে পুরাতন ঢাকা। 

এরপর আসে জমির বিভক্তি। পুরাতন ঢাকার জমিজমা’র প্রাচীন দলিল ঘেটে দেখলে দেখবেন, আগে এক দাগে বিশাল জমির মালিকানা ছিল একজনের। সেগুলো বংশ পরম্পরায় ভাগ হয়েছে বারে বারে। আর এই বিভক্তির কারনে হোল্ডিং নাম্বার বেড়েছে, বেড়েছে মালিকানা। ভিন্ন ভিন্ন বসতবাড়ী গড়ে ওঠার কারনে এগুলোর মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মানুষের হাঁটাচলার উপযোগী গলিগুলো গড়ে ওঠে ব্যক্তিগত জমিজমার মধ্যে দিয়েই। দিনদিন এই জমির বিভক্তির ফলস্বরূপ জালের ন্যায় অভ্যন্তরীন যোগাযোগের জন্য নির্মিত রাস্তাগুলো গড়ে ওঠে। কালের পরিক্রমায় এবং প্রয়োজনে এগুলো ব্যক্তিগত ব্যবহারের গণ্ডি পেড়িয়ে জনগণের চলাচলের রাস্তায় পরিণত হয়েছে। 

ফলে শতবর্ষ পরে আজকে এই সরু রাস্তাগুলো আর পরিবর্ধিত করার কোন সুযোগ নাই। কিন্তু যুগের সাথে আধুনিক মোটর ভেহিকেল এর চলাচল জরুরী হয়ে পড়েছে পুরাতন ঢাকার এসব সরু গলিপথে। তার তাই তো এক লেনের উপযুক্ত পথগুলোতে এখন দুই লেনে যখন যানবাহন চলাচল করে তখন এক ভয়াবহ যানজটের তৈরি হয়ে যায়। পুরাতন ঢাকার এই সরু পথঘাটের উন্নতকরণের বাস্তব সম্মত উপায় হচ্ছে বসতবাড়ী হতে জায়গা ছেড়ে দিয়ে রাস্তাঘাট চওড়া করে নেয়া। কিন্তু সেই বংশ পরম্পরায় ভাগ হতে থাকা জমিগুলো এখন একক মালিকানায় যেটুকু করে রয়েছে তাতে কেউই নিজ জায়গা হতে রাস্তা তৈরীর জন্য জায়গা ছেড়ে দিবে না। আর সেই জমিগুলোর আর্থিক মূল্যও আজকের বাজারে নেহায়েত কম নয়। 

তাই তো, অনেকে নিজের বাড়ী ভাড়া দিয়ে বা বিক্রি করে দিয়ে নতুন ঢাকার দিকে শিফট হয়ে গেছেন। এখন প্রায় অর্ধেকের বেশী জমির মালিকানা দিন দিন হাত বদল হয়ে চলে যাচ্ছে পুরাতন ঢাকার স্থানীয়দের মালিকানার বাইরে। পরিশেষে বলবো, অপরিকল্পিত ঢাকা নগরীর সবচাইতে বড় ভুক্তভোগী কিন্তু পুরাতন ঢাকার বাসিন্দারা। যাদের হাত ধরে এই শহরের গোড়া পত্তন, আজ তাদের নাম শুনলেই অনেকে নাক সিটকান। উচ্চ শ্রেনীয় ঢাকাবাসীর কাছে পুরাতন ঢাকা এক পিছিয়ে পড়া মূর্খ, শিষ্টাচার বহির্ভুত জনপদের নাম। ঘিঞ্জি গলিতে ছড়িয়ে থাকা জরাজীর্ণ বসতবাড়ীর এক পরিত্যক্ত জনপদ। 

কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এই ঘিঞ্জি জনপদের জন্য দায় কি তাদের? বরং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাদের পথঘাটের উন্নয়নের দরকার ছিল, তাদের উন্নয়ন না হয়ে, উন্নত হয়েছে নতুন গড়ে ওঠা ঢাকার জনপদগুলো। বিশ্বের আর কোন প্রাচীন শহরই মনে হয় এমন পক্ষপাতমূলক উন্নয়নের শিকার হয় নাই। তাই, পুরাতন ঢাকার নামে নাক না সিটকে এর ইতিহাস জানুন, জানুন আজকের ঢাকার আঁতুড়ঘর সম্পর্কে। 

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ The Daily Star 

তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ 
1) সত্যেন সেন, শহরের ইতিকথা, সত্যেন সেন রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড), বাংলা একাডেমি জুন ২০১৬ 
2) মুনতাসীর মামুন, ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী (২য় খণ্ড), অনন্যা 
3) মীজানুর রহমান, ঢাকা পুরাণ, প্রথমা প্রকাশন 
4) Rob Gallagher, The Rickshaws of Bangladesh, University Press Limited, 1992 
5) উইকিপিডিয়া 
6) বাংলাপিডিয়া 
7) বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার রিপোর্ট

No comments

Powered by Blogger.