ঈদ টেলিভিশন অনুষ্ঠানমালা - বিনোদনের শতচেষ্টা তথা অপচেষ্টা
প্রায় ছয়টি ঈদ পর ঈদের ছুটিতে ভারত ভ্রমণে যাওয়া হয় নাই আর প্রায় দশটি ঈদ পর ঈদের ছুটির পুরোটা সময় বাসায় কাটিয়ে দিলাম এইবারের ঈদুল আজহায়। এই দুঃখে মনটা খারাপ ছিল ঈদের আগে হতেই, তাও মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম এই বলে যে, অনেকদিন পর বাসায় থেকে ঈদের টিভি প্রোগ্রাম উপভোগ করেই না হয় সময় কাটিয়ে দেয়া যাবে। তো এই আশা নিয়ে ঈদের ছুটির প্রতিটি দিন টেলিভিশন এর সামনে বসে রিমোট চেপে চেপে ভাল কিছু প্রোগ্রামের খোঁজে কেটে গেলে পুরোটা সপ্তাহ। ফলাফল? একরাশ হতাশা ছাড়া আর কিছুই নয়!
পাঁচ থেকে আট দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান শিডিউল ছিল সব কয়টি টেলিভিশনের। ত্রিশটি’র বেশী টেলিভিশন চ্যানেলে প্রায় একই ঘরনার এবং একই ধাঁচের গৎবাঁধা অনুষ্ঠানসূচী। সকালবেলা শুরু হবে দশটা থেকে অখাদ্য কোন একটা মুভি দিয়ে, চলবে বেলা দুপুর দেড়টা-দুটো পর্যন্ত। এরপর দুপুর দুইটার খবর শেষে শুরু হবে টেলিফিল্ম। বিকেলবেলা টকশো, তারকাদের গেম শো অথবা নাচের প্রোগ্রাম। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত সাতদিন ব্যাপী ধারাবাহিক। দশটার পর লাইভ কনসার্ট বা একক নাটক। তো এই ছিল ফর্মুলা। সবাই এই একই রুটিন মেনে অনুষ্ঠান সাজিয়েছে। হয়ত প্রতিবারই সাজাচ্ছে, আমার এতদিন দেখা হয় নাই, তাই কিছুটা অবাক হয়েছি; তারচেয়ে বেশী হয়েছি বিরক্ত। কিন্তু কেন? আসুন সেই আলোচনায় যাওয়া যাক।
তথ্যপ্রযুক্তির এই অবাধ প্রবাহের যুগে যখন দেশী-বিদেশী সকল মুভি যে কোন সময়ই চাইলে দেখা যায়; সেই সময়ে সকালবেলা এই ছুটির সময়ে সব চ্যানেল একযোগে প্রচার করে চলেছে বাংলা সিনেমা। কিন্তু কেন? বরং এই সময়ে হওয়া উচিত ছিল নতুন নির্মিত কোন প্রোগ্রাম এর সম্প্রচার। কারন ঈদের সময়ে এই সকালের সময়েই বাসায় থাকা হয় বেশীরভাগ মানুষের। দুপুরের পর হতে রাত পর্যন্ত চলে নানান আত্মীয় স্বজনের বাসায় ঘোরাফেরা। কিন্তু এই সময়টাকে প্রাইম টাইম হিসেবে কাউন্ট করা হয় না কেন কে জানে? সবাই ঘুমিয়ে থাকে? আসলেই কি তাই? আর মুভিও যদি নতুন বা টিভি প্রিমিয়ার হত তাহলে কথা ছিল। গৎবাঁধা ছক হতে কেউ বের হতে চাইছে না। কেন দুই ঈদে সম্প্রচারের জন্য গত একবছরে মুক্তিপ্রাপ্ত খুব ভাল ভাল ছবিগুলো টিভি’র পর্দায় দেখানোর সুযোগ করে দেয়া যেতে কি পারে না?
দুপুরের টেলিফিল্মগুলো দেখে মনে হয়েছে বাংলাদেশে কাহিনীকার তথা নাট্যকারের বড্ড অভাব। বিগত দশ বছরে দেখা গেছে প্রতিটি সময়েই কিছু পরিচালক হিট লিস্টে থাকে, তখন তাদের নাটকের ছড়াছড়ি থাকে। ফারুকী গং এর রেদওয়ান রনী, ইফতেখার আহমেদ ফাহমী, মোস্তফা কামাল রাজ এর পরের জেনারেশন এর পর এখন চলছে শাফায়াত মনসুর রানা, মাবরুর রশীদ বান্না, মিজানুর রহমান আরিয়ান, আশফাক নিপুন প্রজন্ম। উনারা সবাই অবশ্যই সফল এবং ক্রেয়েটিভ নির্মাতা। সমস্যা হল যখন কাহিনীকার, নাট্যকার, সংলাপ এবং পরিচালনা সব নিজেরাই করা শুরু করে দেন। প্রতিটি সেক্টরের একটি টিম এন্ড নেটওয়ার্ক চেইন আছে; যা ব্রেক করে বিকেন্দ্রীকরণ বাদ দিয়ে একীভূত করে আনা হলে এই চেইন নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে প্রাথমিক দু’একটি কাজে সফলতা আসলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা কখনই সফলতা পায় না। ভারতের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে একসময় হিমেশ রেশমিয়া’র মত কিছু মিউজিশিয়ান নিজেরাই মিউজিকের সাথে সাথে গায়ক বনে গিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে সফলতা পেয়েছিলেন, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা ভুল বলেই প্রমাণিত হয়েছে। বরং বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি সিনেমায় একেকটি গান একেকজন সুরকার হতে নির্মান করে নিয়ে আসছেন প্রযোজকেরা। কারন? বিকেন্দ্রীকরণ... এবং সাথে একঘেয়েমি থেকে দর্শককে মুক্তি দেয়া। তারচেয়ে বড় কথা একজন সুরকার যে খুব ভাল পার্টি সং এর সুর করে দিচ্ছে সে হয়ত সফট মেলোডি ধাঁচের গানের জন্য মানানসই নাও হতে পারেন। ফলে গানের ধরণ অনুযায়ী প্রযোজকেরা গানের সুরকার হয়ে এখন কোরিওগ্রাফার পর্যন্ত আলাদা আলাদা বেছে নিচ্ছেন। আমাদের দেশের নাটকগুলোতে এখন নাট্যকার সংকট রয়েছে বলেই আমার ধারণা। কিছু ফর্মুলায় বন্দী হয়ে আছে নাটকের কাহিনীগুলো। আর তারচেয়ে বড় কথা, একটি নাটক জনপ্রিয় হলে তার সিক্যুয়াল বা সিরিজ চলতেই থাকবে; তা দর্শকদের বিনোদন দিতে পারুক আর নাই পারুক।
এরপরই রয়েছে অভিনেতা কেন্দ্রিক নির্মান। আমাদের নাটকের গত এক দশক ধরেই সম্রাট মোশাররফ করিম সাহেব। তাকে কেন্দ্র করে হাসির নাটকের নামে ভাঁড়ামো দিন দিন বেড়েই চলছে। “হ্যালো”, “ছাইয়া ছাইয়া”, “সিকান্দার বকশ” এর মত হাসির নাটকে দর্শক বিনোদন পেয়েছে। আর সেটা মাথায় রেখে প্রতি বছর বস্তা পচা নাটকের লাইন। জাহিদ হাসানের “আরমান ভাই” দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পর পুরাতন ঢাকাইয়া ভাষায় যেনতেন একটা নাটক নির্মান প্রতিটি টিভি চ্যানেলের যেন নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে যে কথা না বললেই নয়, একেকটা সময় টিভি চ্যানেল জুড়ে কিছু কমন অভিনেতা অভিনেত্রীদের দেখতে দেখতে চোখ ব্যাথা হয়ে যায়।
নাটক আর টেলিফিল্ম নিয়ে শেষ কথা হল, ঈদ অনুষ্ঠান মাত্রই কেন নাটক আর টেলিফিল্ম? এই দুটোকে কেন্দ্র করেই কেন টিভি প্রোগ্রাম শিডিউল তৈরী হয় প্রতিটি ঈদে? বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বলতেই কি নাটক আর টেলিফিল্ম। অথচ সারা বছর ভাল নাটক অথবা টেলিফিল্ম কবে, কখন, কিভাবে টেলিকাস্ট হয়ে যায় কোন খবরই পাওয়া যায় না। এই ঈদে টেলিফিল্ম এর কথা বললে ২০১০ এর পর মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী’র “আয়েশা”র কথা অবশ্যই বলতে হবে, তবে এটি সিনেমা হিসেবে নির্মান করতে পারতেন ফারুকী, খুব ভাল প্লট ছিল। চ্যানেল আই এর সাথে ফারুকী’র “ভাই ব্রাদার্স এক্সপ্রেস” এর দশটি নির্মান এর উদ্যোগও ভাল ছিল। নাটকের মধ্যে শেষের দিকে প্রচারিত “লিটনের গরীবি ফ্ল্যাট” ভালই ছিল। শাফায়াত মনসুর রানা’র “আমার নাম মানুষ” জিটিভিতে প্রচারিত হয়, সোশ্যাল ম্যাসেজ নিয়ে নির্মিত নাটকটি’র চিত্রনাট্য আরও ভাল হলে নাটকটি উপভোগ্য হত বলেই মনে করি। আসলে যখন থেকে চ্যানেলগুলো নিজেরা স্পন্সর যোগাড় করে অনুষ্ঠান কিনে নিচ্ছে, তখন থেকেই বোধহয় ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের সংখ্যা কমে আসছে, নাটক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে কম। আর তাই তো, টিভিতে মুক্তি না দিয়ে “KOLI 2.0” এর মত নির্মাণ মুক্তি পাচ্ছে অনলাইনে।
সিনেমা, নাটকের পর আসে গানের অনুষ্ঠান নিয়ে। লাইভ কনসার্ট গত এক দশক ধরে ঈদ প্রোগ্রামের অতি জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান। এবারো প্রায় সব চ্যানেলেই ছিল এই আয়োজন। তবে এইবার বামবা’র উদ্যোগে সাতদিনব্যাপী আয়োজন আর মাছরাঙ্গায় মিউজিক জ্যামিং প্রোগ্রাম দুটো আসলেই ব্যতিক্রম ছিল। আর প্রতি ঈদের মত দুপুরবেলা দেশ টিভি’র সরাসরি গানের আসর এবারো ছিল, সাথে রাতের কনসার্ট। কিন্তু বামবা’র আয়োজনের কারনেই কি না জানি না, এবার প্রথম সারির ব্যান্ডগুলোকে অন্য কোন প্রোগ্রামে পারফর্ম করতে দেখা যায় নাই। এই ব্যাপারট ভাল লাগে নাই। প্রিয় কিছু ব্যান্ড’কে ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলে ভিন্ন ভিন্ন দিনে দেখবার এবং প্রিয় গানগুলো উপভোগ করার সুযোগ পেল না দর্শকেরা। এবারের আয়োজনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল লেগেছে মিউজিক্যাল জ্যাম এর ব্যান্ড “শুন্য” এবং “চিরকুট” এর যুগল বন্ধী প্রোগ্রামটি।
এক সময় ঈদ মানে ছিল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান “আনন্দমেলা”, “ইত্যাদি”, “শুভেচ্ছা” এগুলো। এখন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান কনসেপ্টটিই হারিয়ে গেছে। কিন্তু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই আয়োজন হতে পারতো ঈদের অন্যতম অনুষ্ঠান। উদ্দ্যোগ আর পরিকল্পনার অভাব। আমার জানা নেই, ঈদ অনুষ্ঠান নিয়ে পর্যাপ্ত “রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট” টাইপ এফোর্ট টিভি চ্যানেলগুলো নেয় কি না? আসলে আদৌ এরকম কোন কিছু হয় কি না প্রশ্ন থেকে যায়? কোটি কোটি টাকার এই বিনিয়োগ কি বৃথা যাবে প্রতিটি উৎসবেই। বিজ্ঞাপন বিরতি থেকে মুক্তি দিতে বিরতিহীন আর স্বল্পবিরতি'র নাটক-টেলিফিল্ম দেখানো হচ্ছে তার বিপরীতে অখাদ্য ধারাবাহিকে ছেয়ে গেছে অনুষ্ঠানের বহুলাংশ। ঈদের মত উৎসবের সময়ে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সাতদিন টিভি সেটের সামনে বসে যেতে হবে! এই মানসিকতা নিয়ে ঈদ অনুষ্ঠানমালা যারা পরিকল্পনা করেন তাদের আসলেই বাহবা দিতে হয়ে.... যদিও দুয়েকটি চ্যানেলে দুয়েকটি ব্যতিক্রমী উদ্দ্যোগ দেখা গেছে; যেমন নাটকে শমী কায়সার'কে অনেকদিন পর দেখা গেল, নির্মাতা হিসেবে নুহাশ হুমায়ুন'কে টক'শো তে হাজির করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো আরও পরিকল্পনা মাফিক হতে হবে, দর্শক পর্যন্ত যথাযথ পথে পৌঁছতে হবে। কারন, মনে রাখতে হবে এই উৎসবের সিজন কিন্তু দর্শকদের দেশীয় চ্যানেলমুখী করার সবচেয়ে বড় সুযোগ। তাই, সারা বছর সঠিক পরিকল্পনা আর গবেষণা দিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে এই ঈদ অনুষ্ঠানমালা। নইলে ভারতীয় চ্যানেলে দৌড়াত্ম বাড়বেই বৈকি কমবে না।
সব শেষে কিছু টিভি নাটক-টেলিফিল্ম যা দর্শক নন্দিত হয়েছে তা উল্লেখ করে আজকের লেখা শেষ করা যেতে পারে।
আয়েশা
আমার নাম মানুষ
সোনালী ডানার চিল
লালাই
পাতা ঝরার দিন
সব গল্প রূপকথা নয়
সিনেমা সিনেমা খেলা
কানামাছি ভোঁ ভোঁ
বিনি সুতোর টান
দ্যা অরিজিনাল আর্টিস্ট
লিটনের গরীবি ফ্ল্যাট
মডার্ন টাইমস
No comments