কালাগুল, রুমডেট এবং একরাশ হতাশা
কোন নাটকের শুরুতেই যদি লেখা হয়, "এই ভিডিও ফিকশনটি কোনভাবেই অ্যাডাল্ট কোন ফিকশন নয়। বাস্তব চরিত্রের আলোকেই গল্পটি সাজানো হয়েছে। যারা অভিনয় করেছেন, তারা শুধুমাত্র সেই চরিত্রগুলোর চিত্রায়ন করেছেন। সবাইকে অনুরোধ করছি ভিডিও ফিকশনটি সম্পূর্ণ দেখে সমালোচনা এবং পর্যালোচনা করার জন্য।" তাহলে কি বুঝোবেন? যা বুঝার তাই তো বুঝবেন, নাকি? সকল নাটক/টেলিফিল্ম/সিনেমায় যেখানে বলা হয় গল্পের কোন চরিত্রের সাথে জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তির কোন সম্পর্ক নেই, সব কাল্পনিক, সেখানে এই নাটকের শুরুতে বলা হল চরিত্রগুলো সব বাস্তব! এখানেই তো মনে হবে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। আরে ভাই, কুছ কালা নয়, পুরোই কালা।
গেল ঈদুল ফিতরে যতগুলো নাটক প্রচারিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি নাটক আলোচনা-সমালোচনায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। নাটকটি নির্মাণের পর নির্মাতা নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন এই নাটক নিয়ে তিনি কঠিন সমালোচনার মুখে পড়বেন। তাই চালাকি করে ঈদের আগে অনলাইনে ট্রেইলার মুক্তি দেন, এবং যথারীতি বাঁধভাঙ্গা সমালোচনার মুখে পড়েন পুরো নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে। আর তাই নাটকটি যখন প্রচার করা হয়, তখন নাটকের কলাকুশলীসহ পরিচালক নিজের সাফাই সংযুক্ত করেছেন নাটকের শেষে। যা আমার কাছে আরও বেশী হাস্যকর মনে হয়েছে। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আর তার জন্য কি শব্দ ব্যাবহার করছেন এটা কিন্তু একটা বড় বিষয়। মনে করুন, আজ আপনারা স্বপরিবারে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন, আপনার বাবা চমৎকার একটা জামা পড়েছেন, যেই পোষাকে উনাকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছে। এখন আপনি সবার সামনে আপনার মা কে বললেন, “মাম্মা তোমার জামাইকে আজ যা লাগছে না, পুরাই একটা মাল” 😜 এর প্রতিক্রিয়া কি হবে? এটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। অথচ এই কমেন্ট টা হতে পারতো এমন, “আম্মু, দেখছো... আব্বুকে আজকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছে”। এই নাটকের কাহিনীকার এবং নির্মাতা “রুমডেট” এর নেগেটিভিটি দেখাতে গিয়ে নিজেরা এমন কিছু সংলাপ এবং দৃশ্যায়ন করেছেন যা তাদের রুচি এবং চিন্তা-ভাবনা’র সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে (নীচ এবং হীন বলে অপমান করতে চাই না)।
নাটকের শুরুতে দেখা যায়, নাটকের প্রধান দুই ছেলে চরিত্র একই রুমে থাকে। একজন তার রুম থেকে বের হয়ে ঠাণ্ডা পানি চায় আরেকজনের কাছে। পানি না পেয়ে শুরু হয় তাদের মাঝে সংলাপ। সেই সংলাপ শুনেই আপনি এই নাটক আর দেখতে চাইবেন না। বাংলা নাটকে যে সকল ভাষা আর শব্দ কখনো ব্যাবহার হওয়ার কথা কেউ ভাবে নাই, সেই পর্যায়ের অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্যালাপে সমৃদ্ধ ছিল এই নাটক। নাটকের একটি অংশের সংলাপ তুলে দেয়া যায় পাঠকের জ্ঞাতার্থে। রুম ডেট করতে গিয়ে কেন্দ্রিয় চরিত্রের অন্যতম সিয়ামের পিঠ নায়িকার নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়। এসময় তার পিঠে রুম মেট তৌসিফ ঔষধ লাগিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘তোর গার্লফ্রেন্ডরে বলতে পারিস না নখ কাটতে। দেইখা তো মনে হচ্ছে তোর জমিতে লাঙ্গল চালাইছেরে।’ !!! উত্তরে সিয়াম বলে, ‘আমি দোস্ত রেগুলার উপর থেকে ট্র্যাক্টর চালাই। একদিন না হয় একটু লাঙ্গল চালাইছে, ওরও তো অধিকার আছে না’ এই সংলাপ শুনে আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না এই নাটক পুরোটা দেখতে। আমিও বন্ধ করে দিয়েছিলাম এই নাটক দেখা। কিন্তু একটি নাটক পুরো না দেখে সমালোচনা করা ঘোরতর অন্যায় বলে কষ্ট করে হলেও পুরো নাটকটি দেখতে হল, তার সাথে ছিল অনলাইনে এতো ক্যাচাল। একটি সুন্দর মূল বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে নাট্যকার এবং পরিচালক একটি রুচিহীন, অশ্লীল বস্তাপচা খিচুড়ি টাইপের কিছু একটা নির্মাণ করলেন। নাটকের শেষ দিকে জোর করে শিশু এবইউজ টেনে এনে নাটকে অনেক মেসেজ দেয়ার অপচেষ্টা করেছেন।
এমন নাট্যকারদের নাটক প্রচারের আগে যে কোন টেলিভিশন অবশ্যই ভেবে দেখবে, তাই না? আর তাই কোন টেলিভিশন চ্যানেলে এই নাটক প্রচার করতে না পেরে অনলাইন টেলিভিশন “থার্ড বেল” নামক একটি চ্যানেলে এই নাটক প্রচার করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেইন স্ট্রিম চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত শতশত নাটককে টেক্কা দিয়ে এই নাটক ছিল এবারের ঈদের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত নাটক! এখন বলি আমি এই নাটকের খোঁজ কিভাবে পেলাম। ঈদের পরে নির্মাতা রেদওয়ান রনি তার ফেসবুক পেজে একটা পোস্ট দিলেন ঈদে কোন নাটকটি আপনার ভালো লেগেছে। প্রায় ত্রিশটির উপর নাটক টেলিফিল্মের নাম এল, যেখানে প্রথম তিনটি’র একটি ছিল এই ‘রুমডেট’ :O বুঝুন অবস্থা, পাবলিকেরও কিন্তু হজম হইছে, নইলে এতোগুলো মানুষ এই নাটকের নাম কিভাবে ঈদের ভাললাগা নাটকের তালিকায় আনতে পেরেছে? সত্যি, এই নাটক দিয়েই কি বাংলা সিনেমার মত নাটকেও অশ্লীলতার আগমন ঘটলো কি না সময়ই বলে দেবে। তবে, এইসব জিনিষ হল নীরব ঘাতকের মত, একটু একটু করে দর্শককে হজম করানো হয়। এই নাট্যকার একসাথে অনেক বেশী পরিমাণে হজম করানোর অপচেষ্টা করে ফেঁসে গেছেন। নাটকের শেষাংশে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেয়া বক্তব্য তাই বলে।
গত বছর দুই ঈদে দুটি জটিল টেলিফিল্ম তৈরি হয়েছিল, প্রথমটি ছিল “ছিন্ন”। ৪ নম্বর সতর্কতা সংকেত আর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তিশা, তারিক আনাম আর লুৎফুর রহমান জর্জ অভিনীত সেই নাটকের শুটিং হয়েছিল কুয়াকাটা সংলগ্ন ফাতরার বনে। সেই টেলিফিল্ম নিয়ে রিভিউ লিখেছিলামঃ টেলিফ্লিম "ছিন্ন" – বৈরী আবহাওায় অসাধারণ একটি নির্মাণ মুগ্ধ করা সেই টেলিফিল্মে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রায় একই মৌলিক ভিত্তিতে ঈদুল আজহায় নির্মিত হয় নাটক “রাতারগুল”। যদিও এটি ছিন্ন’র কাছাকাছি যেতে পারে নাই, তবুও মামুনুর রশিদ, তিশা আর রওনক হাসানের অভিনয়ে ভালই মার্ক নিয়ে উৎরে গিয়েছে। সেটি নিয়েও এক বোকা মানুষের একটা রিভিউ ছিলঃ টেলিফিল্ম “রাতারগুল” – একটি পরিপূর্ণ নির্মাণ।সেই নাটক দুটির ধারাবাহিকতায় এবার ঈদে তৈরি হয়েছে “কালাগুল” যা সত্যি আমাকে অবাক করেছে, কেননা কোন নাটক/টেলিফিল্ম ভালো হলে সেটাকে অনুকরণ করা ভালো কথা, কিন্তু সেই একই মৌলিক ভিত্তিতে দুর্বল নির্মাণ আর গল্প, কিন্তু বিরক্ত ধরাতে বাধ্য। তিনটি টেলিফিল্মেই তিশা কোন কারণে (ভিন্ন ভিন্ন কারণ) ফাতরার বন, রাতারগুল বা কালাগুলে নিজের নিরাপদ গৃহ থেকে মানবপাচারকারী অথবা বাজে লোকের হাতে পড়ে যায়, তারপর যে কোন একটি কেন্দ্রিয় চরিত্র তাকে সেই জায়গা হতে বের করে নিরাপদে ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করে এবং শেষে ব্যর্থ হয়ে একটা বিয়োগান্তক সমাপ্তি ঘটে। খুব আশা নিয়ে দেখতে বসেছিলাম “কালাগুল”, সিলেটের কালাগুলে শুটিং হয়েছে, কিন্তু ছিন্ন বা রাতারগুলে ঐ এলাকার যে দৃশ্যায়ন ছিল, তা এই নাটকে পাওয়া যায় নাই। সত্যি হতাশ করেছেন নির্মাতা।
নোটঃ
রচনা ও পরিচালনাঃ নির্মাতা ইমরাউল রাফাত
অভিনয়েঃ তৌসিফ, সিয়াম, শবনম ফারিয়া প্রমুখ
প্রচারিতঃ অনলাইন টেলিভিশন “থার্ডবেল” (ঈদুল ফিতর ২০১৫)
রচনা ও পরিচালনাঃ ওয়াহিদ আনাম
অভিনয়েঃ তিশা, তারিক আনাম খান, লুৎফর রহমান জর্জ প্রমুখ
প্রচারিতঃ এনটিভি (ঈদুল ফিতর ২০১৪)
রচনা ও পরিচালনাঃ সুমন আনোয়ার
অভিনয়েঃ তিশা, মামুনুর রশিদ, রওনক হাসান প্রমুখ
প্রচারিতঃ বাংলাভিশন (ঈদুল আজহা ২০১৪)
No comments