Header Ads

Header ADS

এইম ইন লাইফ

এমনটা কি চেয়েছিলাম? এসব ভেবে ভেবে আর চোখের জলে ভেসে ভেসে সাঁঝের ঘোর লাগা সময়ে হেঁটে হেঁটে আসছিলাম আমি। জীবনে কত রকমের যে স্বপ্ন মানুষ হিসেবে আমরা দেখি আর কত রকম যে তার ভিন্নতর রূপ তার বুঝি শেষ নেই। ছোটবেলায় “এইম ইন লাইফ” লিখতে গিয়ে ভেবে পাই নাই কি লিখব। একবার মন যদি বলেছে ডাক্তার হব, তখন আবার কে যেন গোপনে বলে যেত ‘ইঞ্জিনিয়ারিং কিন্তু আরও বেশী মজার’। ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার দ্বন্দ্বের মাঝে কখনো এসে প্রলোভন দেখাতো ক্যানভাস-তুলির জাদুর দুনিয়া আবার কখনো কাগজ-কালি’তে জগত গড়ার লেখক-কবি’দের নেশার জগত। তখন মনে হত সব কয়টাই হতে চাই। এ যেন বাবা’র কোলে চড়ে দোকানে গিয়ে সাজানো খেলনার ভাণ্ডার হতে যেটা খুশী সেটা চেয়ে নেয়া। এ যেন ‘চাইলেই পাওয়া যায়’ ধরণের কোন জগত!!! শৈশব-কৈশোরের সেই মরিচা না ধরা মন-জগত যে তখনো জানত না যে, এইম ইন লাইফ ইজ নট ইন মাই হ্যান্ড, ইট’স ডিপেন্ড অন ফেইট...

কর্কশ শব্দে গাড়ির হার্ড ব্রেক কষার শব্দের সাথে আমি গভীর কোন জলের অতলে ডুবে গেলাম। আমি রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত সড়ক পথে কিছুক্ষণ আগেও হাঁটছিলাম, হঠাৎ একি হল, আমি কোথায় চলে এলাম। মাথার মাঝে কেমন একটা তীব্র ঝনঝনানি’র সাথে সেই কর্কশ শব্দ, এরপর আমি কেমন করে যেন কোন নীলাভ ঘোলাটে পানির মাঝে তলিয়ে গেলাম। এখন আমার চারিপাশে সেই নীলাভ পানির জগত। কিন্তু আরও মজার বিষয় হল, আমি সেই পানির দেয়ালে বদ্ধ অবস্থায় ভাসতে লাগলাম। আর সেই দেয়াল জুড়ে আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলাম আমার জীবনের অলিতে-গলিতে। ঐ তো, ঐ যে, ডান পাশের দেয়ালে আমার কলেজ জীবনের ছবিগুলো দৌড়ে যাচ্ছে। ঐ যে আমি, বোকা আমি, যে জীবনের প্রথম দুটি সার্টিফিকেট পরীক্ষায় আশাতীত ভালো রেজাল্ট করে স্বপ্ন ছুঁয়ে দেয়ার মোহে আচ্ছন্ন ছিলাম। কিন্তু তখন কি জানতাম যে, খুব শীঘ্রই এই ভঙ্গুর কাঁচের বিশ্বাসের প্রাসাদ ভেঙ্গে পড়বে, আশৈশব লালন করা ‘এইম ইন লাইফ’গুলো সব নিমিষে হয়ে যাবে সব ঘুমের ঘোরে দেখা রুপকথার গল্পের জগত। 

তারপর এইতো বাম পাশের দেয়ালে আমার সেই ক্রমে ক্রমে হারিয়ে যাওয়ার গল্পগুলো এঁকে এঁকে জড়ো হতে শুরু করেছে। কোনমতে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হওয়ার সান্ত্বনা পুরস্কার নেয়ার জন্য কোন মতে গ্রাজুয়েশনে ভালো ফলাফল করার হাস্যকর দৌড়ঝাঁপ। এরপর সারাটা জীবন শুধু দৌড়ঝাঁপ আর দৌড়ঝাঁপ...

দুবেলা দুমুঠো অন্ন দিয়ে উদরপূর্তি করতে কি প্রাণান্ত আমার ছুটে চলা। ছুটতে ছুটতে কখনো-সখনো হাঁপিয়ে উঠলে পরে অবসন্ন দেহে ঐ যে পড়ে থাকা আমার ক্লান্ত দেহঘড়ি! আহ, তারপরও মাঝে মাঝে স্বপ্নের মায়াজালে জড়িয়ে নতুন নতুন এইম এসেছে আমার জীবনে। ছোট্ট সুখের, ছোট্ট স্বপ্নের এক মায়াবী জীবনের এইম... একটুখানি ভালবাসা’য় ঘিরে থাকা পৃথিবীর এইম... আমার মফস্বল থেকে উঠে আসা নির্বিবাদী লক্ষ্মী বউটি, আমার ছেলে-মেয়ে দুটি, আমার দুই কামরার সেই ছোট্ট নিবাস, আমার ভালবাসার ছোট্ট কুটির... আরও কত ছোট্ট ছোট্ট অনেক কিছু! 

‘বাবা... বাবা...’ কণ্ঠটি কেমন পরিচিত লাগছে। এতক্ষণের এই নীলাভ পর্দার ছবিগুলো সব নির্বাক ছিল, কোন শব্দের প্রাণসঞ্চার ছিল না এই জীবনের চলচ্চিত্রে। সেখানে হঠাৎ করে এই শব্দের সঞ্চারে আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত নয়নে চারিদিকে চেয়ে দেখলাম। নীলাভ তরলের ডুবে থাকা আমার মাথার উপর থেকে কেমন যেন একটা আলোর রশ্মি চুইয়ে চুইয়ে ভেতরে আসছে, আর সেই পথ দিয়ে আসছে এই ‘বাবা’ শব্দটি। হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, এটা আমার মেয়ে তমা’র গলা। ওমা, এখানে তমা মাও চলে এসেছে? কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? আমি বুঝার চেষ্টা করলাম, আমি হাঁটছিলাম রাজপথ দিয়ে... তারপর কি হল? আমি কিভাবে এখানে চলে এলাম? এই নীলাভ তরলের ঘোর লাগা জগতে। আর এইটুকু ভাবতে গিয়েই আমার মাথার ভেতর চিনচিন করে যন্ত্রণা শুরু হল। এই যন্ত্রণা তীব্র থেকে আরও তীব্র হতে শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যে যেন আমার সব চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে গেল... আমি হারিয়ে গেলাম এক অজানা নৈশব্দের জগতে।

এখন মাঝে মাঝে আমি সেই নৈশব্দের জগত থেকে মুক্তি পেয়ে নীলাভ তরলের জগতে ফিরে আসি, মাঝে মাঝে সেই নীলাভ তরলের জগত ভেদ করে সেই আলোর দেখা পাই, পাই কিছু শব্দের আনাগোনা। অর্থহীন সেই শব্দগুলো আমার চিন্তার জগতে প্রবেশ করাতে যেতেই শুরু হয়ে যন্ত্রণা, কিন্তু আমি না চাইলেও যন্ত্রণা বাড়তে থাকে সেই শব্দগুলোর উলম্ফনে। 

‘ডাক্তার... বাবা বাঁচবে তো... এতো টাকা... আইসিইউ... প্রতিদিন বিশহাজার... লাইফ সাপোর্ট... কোমা...’ এরকম নানান অর্থহীন শব্দ শুনতে শুনতে আমি হারিয়ে যাই অজানা কোন জগতে, আবার মাঝে মাঝে ফিরে আসি সেই নীলাভ তরলের জগতে। এভাবে আসা যাওয়া চলতে চলতে আমি কখন যেন চিরতরে চলে এলাম এক নিকষ কালো আঁধারের জগতে, যে জগতে শুধু আঁধারের খেলা। সেই আঁধারের মাঝেই আমি আমার পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর চিত্রগুলো সব দেখে যাই নির্বাক দর্শক হয়ে। আমার প্রতিটি স্বপ্নের গড়ে ওঠা, ভেঙ্গে যাওয়া, আমার হেরে যাওয়া, আমার ক্ষয়ে যাওয়া... এখন আমি সারাক্ষণ এগুলো দেখে এই আঁধার জগতে কাটিয়ে দেই অনন্ত মহাকাল, আর খুঁজে ফিরি আমার ‘এইম ইন লাইফ’।

No comments

Powered by Blogger.