বাংলা ভাষার প্রতিবেশীরা
২০১৮ সালের ডিসেম্বর এর এক ভারত ভ্রমণের শেষে দেশে ফেরার সময় এয়ারপোর্ট লাউঞ্চে বসে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়েছিল। বৃহত্তর বাংলা’র কথা প্রায়শই নানান জায়গায় শোনা যায়। এর বাস্তবতার এক ভিন্ন রূপ সেবার ধরা দিয়েছিল বাংলা ভাষার উৎসমূলের ব্যাপ্তি এবং প্রভাব এর কথা চিন্তা করে। সেবারের দুই সপ্তাহের ট্যুরে গন্তব্য ছিল ভারতের চারটি প্রদেশঃ পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম এবং নাগাল্যান্ড। অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করছিলাম পশ্চিমবঙ্গ’র বাইরে উড়িষ্যা, আসাম এবং নাগাল্যান্ড এর কথ্য ভাষার প্রায় শব্দই বাংলার খুব কাছ ঘেঁষা। ইতিহাস বা সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম না বিধায় আগে এতটা ধারণা ছিলো না। উৎসুক হয়ে এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, এদের সবার আঁতুড়ঘর বাংলার সাথেই। সবাই একই বংশের সন্তান। পশ্চিমবঙ্গ’র বাংলা, উড়িষ্যা’র ওড়িয়া, আসাম এর অসমিয়া আর নাগাল্যান্ড এর নাগামিজ; সকল ভাষার কথা শুনে মনে হবে যেন বাংলা ভাষার কথা শুনছেন; কিন্তু অনেকটাই বুঝতে পারছেন না। এর কারন অনুসন্ধানে যা জানতে পারলাম তা নিয়ে আজকের এই পোস্ট, সাথে বাংলা ভাষাভাষী নিয়ে গঠিত অঞ্চলের ব্যাপ্তি নিয়ে অবাক হওয়া।
পৃথিবীতে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় চার হাজার ভাষা প্রচলিত রয়েছে। এই ভাষাসমূহের মধ্যকার উৎপত্তিগত সাদৃশ্যতা বিবেচনা করে এদের কয়েকটি মূল ভাষা শ্রেণীতে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলঃ
(২) সেমিটিক-হেমিটিক
(৩) বান্টু
আজকের বাংলা ভাষার জন্ম এই ইন্দো-ইউরোপীয় শ্রেণী হতে, যার শেকলটা অনেকটা এরকমঃ ইন্দো-ইউরোপীয় > আর্য > ভারতীয় > প্রাচীন ভারতীয় আর্য > প্রাচীন ভারতীয় কথ্য আর্য > সংস্কৃত হয়ে মাগধি প্রাকৃতের (খ্রি.পূ ৬০০-খ্রি ৬০০) পরবর্তী স্তর মাগধি অপভ্রংশ এবং তৎপরবর্তী স্তর অবহট্ঠের মধ্য দিয়ে নব্যভারতীয় আর্যভাষারূপে বাংলার উদ্ভব হয়। ভাষা পরিবার হিসেবে সংক্ষিপ্ত রূপ এমনঃ ইন্দো-ইউরোপীয় > ইন্দো-ইরানীয় > ইন্দো-আর্য > পূর্ব ইন্দো-আর্য > বাংলা-অসমীয়া > বাংলা। আর এর সঙ্গেই উদ্ভূত হয় পূর্বমাগধীয় আরও দুটি ভাষা ওড়িয়া ও অসমিয়া।
যে কারণে এই ভাষাগুলোর সাথে অনেক মিল বাংলা ভাষার। কিন্তু অসমীয় বর্ণমালার সাথে বাংলা বর্ণমালার অনেক মিল থাকলেও অমিল ওড়িয়া ভাষার সাথে। এর কারণ দক্ষিণ ভারতীয় প্রভাব। ওড়িয়া ভাষার বর্ণমালাগুলো গোলাকার যার কারণ হিসেবে এর সৃষ্টিকালীন সময়ে গোলপাতায় ধারালো কলম-সদৃশ বস্তু দিয়ে লেখা হত বলে সরলরেখার ব্যবহার এই বর্ণমালায় পরিলক্ষিত হয় না। ওড়িয়াতে ২৮টি ব্যঞ্জনধ্বনি ও ৬টি স্বরধ্বনি আছে। অপর দিকে অসমীয় ভাষার অসমীয়া ভাষা বর্তমানে পূর্ব নাগরী লিপিতে লিখা হয়। বাংলা বর্ণমালার একটি সামান্য পরিবর্তিত সংস্করণে "অসমীয়া বর্ণমালা" তৈরি করা হয়েছে। বাংলা বর্ণমালার মতই এতে ১১টি স্বরবর্ণ আছে। তবে ব্যঞ্জনবর্ণ ও অন্যান্য চিহ্ন আছে ৫৪টি। যেগুলোর সাথে বাংলা ভাষার রয়েছে প্রচুর মিল।
অপরদিকে নাগামিজ ভাষার সৃষ্টিই হয়েছে অসমীয় ভাষা থেকে। নাগামিজ নাগাল্যান্ড এ প্ৰচলিত একটা মিশ্ৰ ভাষা যা অসমীয়া ভাষাকে ভিত্তি করে এর সৃষ্টি হয়েছে। তার সাথে বাংলা, হিন্দী, বিভিন্ন নাগা ভাষা এবং অন্যান্য ভাষারো কিছু মিল দেখা যায়। অল্ ইণ্ডিয়া রেডিও ' স্টেশনের কর্মীরা "নাগামিজ" (Naga+Assamese) শব্দটির উদ্ভাবন করেন; যা এই মিশ্র ভাষার একটি স্বতন্ত্র নাম প্রদান করে। যদিও এর বর্ণমালা’র সাথে বাংলা বা অসমীয় বর্ণমালা’র লিখিত রূপের মিল পাওয়া যাও না।
পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ এর বাইরে ত্রিপুরায় বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও বিহার এবং ঝাড়খণ্ড এ বাংলা ভাষার প্রভাব এবং বিস্তার রয়েছে প্রচন্ড রকম। তাই সকল বিভাজন একক ভুলে গিয়ে কল্পনা করতে মন চায়, বাংলা ভাষা ভিত্তিক অঞ্চলের বিশালতাটুকু... ত্রিপুরা, বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, নাগাল্যান্ড ... ভাবা যায়!!!
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এর প্রাক্কালে সকল বাংলা ভাষাভাষী এবং এর আঁতুড়ঘর এর প্রতিবেশী ভাষাভাষী’দের জন্য ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর শুভেচ্ছা রইবে
হুট করেই, অতি সম্প্রতি বাংলা বর্ণমালা'র এই ক্রমবিবর্তন এর ছবিটি সংগ্রহে পেয়ে গেলাম, তাই এই পোস্টে সংযুক্ত করে দিলামঃ
No comments