আহা জীবন (গান-গল্প ০১)
গত সপ্তাহের ঘটনা, পহেলা বৈশাখের ভোরবেলা, বহুবছর পর তোমাকে দেখা। আমি সাধারণত উৎসবের দিনগুলো এড়িয়ে যাই। সঙ্গোপনে নিজেকে যতটা সবার থেকে আড়ালে রাখা যায়, তাতেই যেন আমার স্বস্তি। আসলে তোমায় হারানোর পর থেকে জীবন এখন আর যাপন করা হয় না, এখন শুধু বহন করা। সেদিন ভোরবেলা আমি ফিরছিলাম গ্রামের বাড়ী থেকে ঢাকার জনবহুল নির্জনতায়, যেই নির্জনতা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম তোমার মাঝে, যেই নির্জনতা আমাকে গ্রাস করেছে তুমিহীনা জীবনে। কমলাপুর রেলষ্টেশন থেকে লোকাল বাসে আমার যাত্রা, উদ্দেশ্য সেই আগের কল্যাণপুরের সামাদ মিয়া’র মেসের ছয় ফিট বাই আট ফিটের ঝুপড়ি ঘরখানা। কিন্তু পথে বাস থেমে গেল, সামনে আর যাবে না, রাস্তা বন্ধ। কি করার, ভোর বেলার আকাশ অনেকদিন দেখি না। কারণ রাতগুলো বড্ড ব্যস্ত থাকতে হয় তুমি আর তোমার স্মৃতি’র সাথে অসম লড়াই করে। অসম! কারণ, প্রতিবার পরাজিত একজনই হয়, আর সে কে? নিশ্চয়ই তুমিই ভাল বুঝতে পারবে। সেদিন পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রভাতে হেঁটে হেঁটে রমনার সম্মুখটা পার হচ্ছিলাম, কি মনে করে ডানে তাকালাম উৎসবের লোকজনে ঠাসা রমনা বটমূলের চত্বরটার দিকে। সেই ছিল আমার ভুল, যে আমি গত কয়েকবছর দেখি না কোন আলোর মিছিল, কোন সুরের বাতাস গায়ে মাখি না, কেন আমি সেদিকে তাকালাম কে জানে? হয়ত ছিল ভাগ্যের লিখন। সেই হাজারো মানুষের ভিড়ে জন্মান্তরের জন্য হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া তোমার মুখখানি দেখে থমকে গেলাম। কেন? দেখা হওয়ার তো কোন কথাই ছিল না, তাও এমন সময়ে, এমন জায়গায়। তুমি আমায় দেখনি, আমি দূর থেকে তোমাকে দেখে থমকে গেলাম, পথ ভুল করে যেন ঢুঁকে পড়লাম রমনা বটমূলের সেই আনন্দ উৎসবের মায়াবী জগতে। তুমি তন্ময় হয়ে গান শুনছিলে, আর আমি আড়াল থেকে তোমায় দেখছিলাম। কতটা সময় তন্ময় হয়ে ছিলাম জানি না, জানি না কতশত মানুষের পা মাড়িয়ে যাওয়া সহ্য করেছে আমার ধুলোময় নগন্য পা জোড়া আর তার জীর্ণ চপ্পলখানি। শতবার চেষ্টা করেও আমি তোমার কাছে যেতে পারলাম না, তোমার পিছু পিছু চললাম চারুকলা’র প্রাঙ্গনে, সেখান হতে মঙ্গল শোভাযাত্রা, তোমার পিছু পিছু একসময় তোমাদের পুরাতন ঢাকার সেই চেনা গলি’র মুখে তোমাকে হারিয়ে যেতে দেখলাম। জানি কাছে আসলেই, এক লহমায় আবার হারিয়ে ফেলব তোমায়, সেই আগের মত, চিরতরে।
ভয়ে ভয়ে এরপর গত কিছুদিন আমি নিয়মিত রাস্তা ভুলে গিয়ে সেই অনেককাল আগের হারিয়ে যাওয়া পথে হেঁটে বেড়াতে লাগলাম। দাঁড়ি-গোঁফ জমা এই আমাকে তুমি কি আজ চিনতে পারবে? বোধহয় না। বারবার ইচ্ছে করছিল সেই গলির পথ ধরে তোমাদের সেই হলদে দোতলা বাড়ীটিতে ঠিক আগের মত করে হাজির হই। তোমার বাবার রাগী রাগী চাহনি উপেক্ষা করে সোজা তোমাদের ছাঁদের ঘরে। তোমার সাজানো গোলাপ আর বেলী ফুলের বাগানের ঘ্রাণ কতদিন পাই না, কতদিন পাই না তোমার দেহের সেই পাগল করা নোনতা সুবাসটুকু। কিন্তু পারি না, পারি না আজ তোমার মুখামুখি হতে। কতশত পাওয়ার মাঝে দু’চারটি না পাওয়া মাঝে মাঝে কত বড় হয়ে দেখা দেয়। বড্ড অভিমান করে যে দূরে সরে যাওয়ার শুরু হয়েছিল, তা যে ঝড় হয়ে আমাকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের ন্যায় করে দিয়ে তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে বহুদূর, তা কি স্বপ্নেও কখনো ভেবেছিলাম।
তোমায় দেখতে বড় ইচ্ছে করে এখন আবার নতুন করে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। সেদিনের পর থেকে তোমায় আর দেখি নাই, জানো? আমি প্রতিদিন তোমাদের বাসার পথের সেই গলির মুখে নতুন গড়ে ওঠা চায়ের দোকানটায় বসে আমার সকাল, দুপুর আর রাতের খাবার সেরে বাসায় ফিরি মাঝরাতে। মনে আছে, আগে তুমি আর আমি তোমাদের বাসার ছাঁদে গল্প করে সন্ধ্যার আগে আগে পলাশীর মোড়ে যেতাম চা’য়ের জন্য। তোমার বাবার সেই কি রাগ, বাসার চা কি মুখে দেয়া যায় না? জানো, গত পরশু উনাকে দেখলাম, কেমন বুড়ো হয়ে গেছেন, মাথার চুলসব সাদা হয়ে গেছে, দাঁড়িও রেখেছেন ছোট করে। সময় কিভাবে সব বদলে দেয়, তাই না? এই দেখ না কেমন বদলে গেছি তুমি আর আমি। নাহ, কথাটা ঠিক হল না, তুমি বদলে গেছ কি না, তাতো জানি না। সেদিনের দেখায় তোমাকে সেই আগের মতই মনে হচ্ছিল, আমার অপ্সরা... বোকা মন আমার, অবুঝ মন। আমার বুকের গভীরে গুমরে কাঁদা না বলা হাজারো কথা যেন প্রতিরাতে আমার কাছে অভিযোগ করে, প্রার্থনা জানায় মুক্তির। আমি পরম মমতায় তাদের বুকের আরও গভীরে পুষে রাখি। আমার ভালোবাসার পরশে নীল বেদনা’র চাদর যেন আষ্টপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে আমার সব বোবা কান্নাগুলোকে। রাত শেষ হলে আমি আবার প্রতিক্ষায় থাকি নতুন কোন দিনে তোমায় ফিরে পাবার। তারপর আবার, দিন-রাত্রির খেলা শেষে অপেক্ষার প্রহর। নিয়মতান্ত্রিক পৃথিবীর এ কেমন অনিয়ম? বোকা মন যতই ভাবুক তোমাকে সে হয়ত বা ফিরে পাবে, বাস্তবে নয়ত কোন এক পরাবাস্তবে... কিন্তু তা কি আর হয়, ঘোর লাগা রাতের মায়াবী ভ্রমগুলোকে প্রতারক দিন যে, নির্মমভাবে ভাবে মনে করিয়ে দেয়, আমি তোমার কেউ নই, কেউ নই, কেউ নই।
পাদটীকাঃ অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল খুব প্রিয় কিছু গানের লিরিকের ছায়ায় ছোট গল্প লেখার। অনেক প্রিয় গান আছে, যেগুলোকে মন চায় গল্পে পরিণত করতে। কিন্তু পটভূমি কি হবে তা ঠিক করা মুস্কিল। কেননা গানগুলো হয় এমন যে, নানান আঙ্গিক থেকে তাকে বিচার করা যেতে পারে। একটা গান, ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে ধরা দেয় ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে। কিন্তু কোনটিই হয়ত মিথ্যে নয়। আমি আমার আঙ্গিকে সাজালাম গানের কথা’র ছায়ায় এই গল্পটি। ভিন্নমত বা পরামর্শ থাকলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কমেন্টে। অনেকদিন গল্প লিখি না, হুট করে সন্ধ্যের পর বসলাম লেখাটি লিখতে। টানা লিখে পোস্ট করা, তাই খুব বেশী মন্দ হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই। আর গানটি সম্পর্কে কিছু তথ্য আগ্রহী পাঠকদের জন্য নীচে তুলে ধরা হল।
অ্যালবামঃ ক্যাপসুল ৫০০এমজি
সুরকারঃ আইয়ুব বাচ্চু
গীতিকারঃ লতিফুল ইসলাম শিবলী
বছরঃ ১৯৯৫
বিভাগঃ ব্যান্ড
সম্পূর্ণ লিরিক্সঃ
আমি তোমার কাছে আসি না চলে যেতে হবে বলে
তোমাকে ভালোবাসিনা তোমাকে হারাবার ভয়ে
তোমাকে ভালোবাসিনা তোমাকে হারাবার ভয়ে
এ কেমন অনিয়ম
কাঁদায় আমায় প্রতিক্ষণ
আহা জীবন
ফিরতে বড় ইচ্ছে করে ফেরারী ওই পথটি ধরে
যেথায় তুমি দাড়িয়ে আছো বহুদুরের ঘরে
কন্ঠে আমার হারাবার গান অনেক পাওয়ার অনেক পরে
পাওয়া না পাওয়া ম্লান হয়ে যায় অভিমানী ঝড়ে
এ কেমন অনিয়ম
কাঁদায় আমায় প্রতিক্ষণ
আহা জীবন
দেখতে বড় ইচ্ছে করে তোমায় অনেক না দেখায়
বোবা ভাষা প্রাণ ফিরে পায় আমার ভালোবাসায়
রাত ফুরালেই রাতের কাছে জমিয়ে রাখি অনেক আশা
আঁধারগুলো দেয় ফিরিয়ে আমার সারাদিন
এ কেমন অনিয়ম
কাঁদায় আমায় প্রতিক্ষণ
আহা জীবন
গানটি আগে যারা শুনেন নাই বা আরেকবার যারা শুনতে চান তাদের জন্যঃ
No comments