সৃষ্টিকর্তার দোহাই, সড়কে চলাচলের সময় সতর্ক হন।
আজ একদিনে শাহবাগ এলাকায় দু দুজন স্কুল ছাত্রী বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছেন রাস্তা পারাপারের সময়। একজনের বয়স ১২ আর অন্যজনের ১৪ বছর মাত্র। সকাল ৯টার দিকে মৎস্য ভবনের সামনে বাসের ধাক্কায় প্রাণ যায় সাবিহা আক্তারের। বিকেল চারটার দিকে শাহবাগ মোড়ে রাস্তা পারাপারের সময় একটি যাত্রীবাহী বাস খাদিজাকে ধাক্কা দেয়। এর মধ্যে খাদিজার বাড়ী কুমিল্লা, সে ঢাকা এসেছিল বেড়াতে, শিশুপার্ক ঘুরে বিকেলে খাবারের জন্য শাহবাগ মোড়ে একটি রেস্টুরেন্টে যাওয়ার সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে এই মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। হাজারো বার আওড়ানো বুলি, ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মুল্য’ আবারো মিথ্যে প্রমাণিত হল।
বেশীরভাগ দুর্ঘটনায় চালকদের আমরা দোষী সাব্যস্ত করে থাকি। কিন্তু বাস্তবতা কি? একটু বিচার বিশ্লেষণ করা যাক? প্রথমে গত তিন মাসে আমার নিজের দেখা তিনটি ঘটনা বলা যাক।
ঘটনা ০১ঃ
আমি মতিঝিল থেকে যাচ্ছিলাম মিরপুর, সিটিং গাড়ী, চলছে দুরন্ত গতিতে। আমি বসেছি গেটের সাথের ঠিক জানালার পাশের সিটে। সময় আনুমানিক ছয়টা হবে, অফিস সব ছুটি হয়েছে মাত্র। বাস তখন মৎস্য ভবনের সিগ্ন্যাল পার হচ্ছে। পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে একটু ঐ সময়কার রাস্তার গাড়ী চলাচলের দৃশ্য সম্পর্কে ধারনা দেয়া যাক। ফুটপাথ আর রোড ডিভাইডার এর মাঝে দিয়ে তিন লেনে সব গাড়ী ছুটছে; আমাদের বাস মাঝখানের লেনে। মৎস্য ভবনের সিগ্ন্যালের মোড়ে হঠাৎ আমাদের গাড়ীর হেল্পার এক মহিলাকে বাম হাতে জড়িয়ে চলন্ত গাড়ীতে রাস্তা হতে তুলে নিল। আমি তাকে ঝাড়ি দিব চিন্তা করছি, তখন দেখি মহিলা হতভম্ব চেহারায় কাঁপছে। আসলে ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা কিছু বুঝে উঠতে পারি নাই। এবার হেল্পার ঘটনা ব্যাখ্যা করল আমাদের। ত্রিশ বছর বয়সী ঐ ভদ্র মহিলা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাসের জন্য। সিগ্ন্যাল ছাড়া অবস্থায় নিজের কাঙ্ক্ষিত বাসের দেখা পান, যদিও তা ছিল চলন্ত এবং ফুটপাথ হতে সবচেয়ে দূরে, রোড ডিভাইডার এর পাশের লেনে। সেই অবস্থায় ভদ্রমহিলা দৌড় দেন বাসের উদ্দেশ্যে, কিন্তু ইতোমধ্যে মাঝখানে আমাদের গাড়ী চলে আসে, আর মহিলার ঠিক পেছনে আরেকটি চলন্ত গাড়ী। মহিলা যখন ঠিক গাড়ীর নীচে চাপা পড়বেন, ঠিক তখন আমাদের হেল্পার তাকে দেখতে পেয়ে স্মার্টলি ডান হাতে দরজার হাতল চেপে ধরে বাম হাতে মহিলাকে রাস্তা হতে বাসে তুলে নেয়। এই পুরো ঘটনা দু’তিন সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে, ভদ্র মহিলা নিজের চোখের সামনে মৃত্যু দেখতে পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই। তাইতো বাসে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন। পরবর্তী স্টপেজে গাড়ী থামিয়ে উনাকে নামিয়ে দেয়া হয়।
ঘটনা ০২ঃ
নীলক্ষেত মোড়, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের বিপরীতের রাস্তায় সব গাড়ী জ্যামে সিগন্যালে আটকে আছে। অনেকক্ষণ পরে সিগন্যাল ছাড়ল, গাড়ী সব মাত্র মুভ করা শুরু করেছে, বাসের কন্ডাক্টার আর গেটের কাছের এক যাত্রী চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘অই ব্রেক কর!’। গাড়ী হার্ড ব্রেক কষল, যদিও তেমন গতি ছিল না। দুই গাড়ীর মাঝে এক হাতেরও কম জায়গায় বছর বিশেকের এক হালকা পাতলা তরুণী আঁটকে আছে। পাতলা বলেই হয়ত ভাগ্য জোরে বেঁচে গেছে। ঘটনা খুবই সিম্পল, কিন্তু ভয়াবহ। মেয়েটি আর তার সঙ্গী ছেলে একজন, দুজনে দুই বাসের মাঝখান দিয়ে পেছন থেকে ঢুঁকে পড়েন রাস্তা পার হবেন বলে। পেছনে থাকায় দুই গাড়ীর ড্রাইভারই তাদের লক্ষ্য করেন নাই। ছেলেটি দ্রুত বের হয়ে গেলেও মেয়েটি আঁটকে যায়।
ঘটনা ০৩ঃ
মিরপুর রোডে, ধানমণ্ডি মাঠের পাশের মেইন রোডে, ফুটপাথ হতে একটা বছর বিশেকের ছেলে চলন্ত গাড়ীর উদ্দেশ্যে দৌড় শুরু করল, পায়ে স্যান্ডেল। বাসের গতির সাথে টিকতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ার মুখে হেল্পার তাকে দেখতে পেয়ে গেটে জোরে একটা বাড়ি দেয় গাড়ী ব্রেক করার জন্য, সাথে হাত বাড়িয়ে সেই ছেলেকে ধরে ফেলে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে। ছেলেটি যে পজিশনে ছিল নির্ঘাত গাড়ীর চাকার নীচে চলে যেত।
এই ঘটনাগুলো এ'কারনে বলা যে, আমরা নিজেরা কতটুকু অসতর্ক এবং অবিবেচক হয়ে যাই রাস্তায় গাড়ীতে উঠতে গিয়ে এবং পথ পারাপারে। ঢাকা শহরে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে দুই তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। একবার একটা সিগন্যালে আটকে গেলে দশ-পনের মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। তাই সিগন্যাল ওপেন হলেই সকল গাড়ীর চালক পাগলের মত চেষ্টা করে গাড়ী নিয়ে সিগন্যাল বাতি পার হয়ে যেতে। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সিগন্যাল, মানিক মিয়া এভিনিউ – আসাদগেট সিগন্যাল, ফার্মগেট সিগন্যাল, শাহবাগ সিগন্যাল, কারওয়ান বাজার সিগন্যাল, বনানী-মহাখালী, গুলশান, বিমানবন্দর এমন জায়গাগুলোর সিগন্যাল পয়েন্টে গাড়ী লম্বা সময় ধরে আটকে থাকে। সিগন্যাল ছাড়তেই সব গাড়ী ব্যস্ত হয়ে পড়ে সিগন্যাল পার হয়ে যেতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ঠিক ঐ সময়ই দেখা যায় মানুষজন রাস্তা পার হতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং বেশীরভাগ দুর্ঘটনা এই সময়টায় ঘটে রাজধানী ঢাকায়। প্লিজ দোহাই আপনাদের ঐ সময়টায় ভুলেও রাস্তা পার হবেন না। আরেকটা কথা, থেমে থাকা গাড়ীর পেছন থেকে মাঝখানে কখনো রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করবেন না। সম্ভব হলে ড্রাইভার অথবা হেল্পারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাস্তা পার হন।
আমাদের এই শহরে রাস্তা পারাপার একটা কঠিন ব্যাপার। গুলশান, শাহবাগ, মানিক মিয়া এভিনিউ এর মত জায়গাগুলোতে রাস্তা পারাপার আসলেই দুরূহ। পর্যাপ্ত ফুট ওভারব্রিজ এর অভাব, সাথে যেখানে আছে, তাও সঠিক জায়গায় নেই, থাকলেও দখল হয়ে আছে হকারে। জেব্রা ক্রসিং কয়জন ড্রাইভার বুঝে আর কয়জন পথচারী? তা একটা প্রশ্নের বিষয়।
ড্রাইভারদের নিয়মভংগ আর বেপরোয়া গাড়ী চালানো নিয়ে কিছু নাই বা বলি। তো করনীয় কি? করনীয় একটাই, আরও সাবধান হন। মনে রাখবেন দুর্ঘটনা বলে কয়ে আসে না, যখন আসে তখন আর কিছু করার থাকে না। আমি, আমার ছোট ভাই দুজনেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। আমারটা তো এমন ছিল, যেখানে দুর্ঘটনা হওয়ার কোন কারণ ছিল না। আজিমপুরে বাসে থেকে নেমেছি সবার শেষে, ড্রাইভার গাড়ী ইউটার্ন করাচ্ছে, হঠাৎ আমি রাস্তার ফুটপাথের গ্রিলের মাঝে আটকে গেলাম, গাড়ীর পেছনের কর্নারটা ঠিক আমার পেটের মাঝে আলতো ছোঁয়া দিয়ে চলে গেল। আর ইঞ্চি দুয়েক বেশী এগিয়ে আসলে আমার পেট ফুঁড়ে গাড়ী চলে যেত। এখানে আমার বা ড্রাইভারের কারো দোষ ছিল না, তবুও সেদিন মারা যেতাম নির্ঘাত। এরপর থেকে বাসে থেকে নেমেই আগে পাশে নিরাপদ জায়গায় চলে আসি, তারপর বুঝেশুনে চলাচল শুরু করি।
এই প্রসঙ্গে আরও দুটি ঘটনা তুলে ধরিঃ
ঘটনা ০৪ঃ
আমার বন্ধু স্থানীয় একজনের বাবা, রিটায়ার্ড সরকারী চাকুরে, রাত নয়টা, সাড়ে নয়টার দিকে বাসা হতে বের হয়েছিলেন কিছু একটা কিনতে। ফুটপাথের নিরাপদ সড়কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি অটোরিকশা উনার উপর চাপা দেয় এবং উনি নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
ঘটনা ০৫ঃ
হাতিরঝিল থেকে কারওয়ান বাজার এসে হোটেল সোনারগাঁও এর সামনে সব গাড়ী সিগন্যালে আটকে আছে। বাস হতে আমার পাশের ষাটোর্ধ ভদ্রলোক নেমে হোটেল সংলগ্ন ফুটপাথে উঠছেন। ঠিক তখন হোটেল সংলগ্ন শেকল দিয়ে পৃথক করা লেন দিয়ে তীব্র গতিতে মোটর সাইকেল চালিয়ে আসা এক ছেলে ব্রেক হারিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে চিৎপটাং। কিন্তু ঠিক তখন ঘটল ভয়াবহ ঘটনা, মোটর সাইকেলটি রাস্তায় তীব্র গতিতে আছড়ে পড়ে গিয়ে লাগে বাস হতে নামা ঐ ভদ্রলোকের পা'য়ে। বাস হতে আমরা যে শব্দ পাই তাতেই বুঝে উঠি উনার পা'খানি ভেঙ্গে গেল বুঝি লম্বা সময়ের জন্য। উনার চিৎকার আর কান্না শুনলাম, সাথে সাথে উনাকে ধরে একটি সিএনজি অটোরিকশা করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।
উপরের দুটি ঘটনাতেই কিন্তু ভিক্টিম নিরাপদ স্থানেই ছিল, কিন্তু আজরাইল যেন সেখানেই হামলে পড়ল। তাই আপনার আমার বেপরোয়া আচরণে কিন্তু আরেকজন বিপদগ্রস্থ হচ্ছে। হাইওয়ের এক্সিডেন্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশীরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে হুট করে পথিমধ্যে এসে পড়া মানুষ থেকে শুরু করে গরু-ছাগল'কে রক্ষা করতে গিয়ে। তাই, এদিকটাও লক্ষ্য রাখা উচিত। হুট করে রাস্তা পার হতে যাওয়া পথচারীর কারণে চলন্ত গাড়ী হার্ড ব্রেক কষে এবং গাড়ীর যাত্রীরা এতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, এমন ঘটনা অহরহ দেখা যায়।
শেষে সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরে আপনাদের কাছে করজোড় করে অনুরোধ করছি এগুলো মাথায় রাখা এবং মেনে চলার জন্যঃ
- চলন্ত গাড়ীতে উঠার চেষ্টা কখনো করবেন না।
- চলন্ত গাড়ী হতে নামবেন না, যত আস্তেই তা চলতে থাকুক।
- নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া, পথিমধ্যে গাড়ীতে ওঠানামা হতে বিরত থাকুন।
- সিগন্যাল ছাড়া অবস্থায় কখনই রাস্তা পার হবেন না।
- কোন থেমে থাকা গাড়ীর সামনে দিয়ে রাস্তা পার হতে হলে, ড্রাইভারের দৃষ্টি আকর্ষণ করুন, অতঃপর রাস্তা পার হন।
- আশেপাশে ফুট ওভার ব্রিজ থাকলে তা ব্যবহার করুন।
- জেব্রা ক্রসিং না থাকলে রাস্তা ফাঁকা না হলে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করবেন না।
- যত তাড়াই থাকুক, নির্ধারিত স্থান হতে গাড়ীতে উঠুন, পথিমধ্যে হতে নয়।
- আপনার গাড়ীর ড্রাইভারকে নির্ধারিত সীমার চাইতে বেশী গতিতে গাড়ী চালানো থেকে বিরত রাখুন।
- রাস্তা পারাপারের সময় দুদিকেই লক্ষ্য রাখুন; কেননা নিয়মভঙ্গ করে এখন উল্টো পথেও গাড়ী ছুটে চলে আমাদের সড়কগুলোতে।
- সর্বোপরি নিজে সচেতন হউন, অন্যকে সচেতন করুন।
“একটি দুর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না” যেন না হয়। তাই, সৃষ্টিকর্তার দোহাই, সড়কে চলাচলের সময় সতর্ক হন। মনে রাখবেন, আপনার জীবন শুধু আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, আপনার পরিবার-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব সকলের জন্যই মহামূল্যবান।
No comments