সত্তার ছায়ার আর্তনাদ
বড় ভাইয়া অল্পতেই রেগে যায়। টেম্পার লুজ করা তার একটা নিত্যদিনের ঘটনা। যেনতেন বিষয়ে রেগে অস্থির। এখন বাবার সাথে তার প্রচণ্ড কথা কাটাকাটি হচ্ছে। কুলখানির তবারকের মিষ্টির আইটেম সিলেকশন নিয়ে দুজনের মাঝে বাক-বিতণ্ডতা চলছে।
“বুঝলাম না বাবা, কুলখানির মিষ্টিতে এত আইটেম দেয়ার দরকার কি?”
“তোর বুঝতে হবে না, এত বুঝিস বলেইতো আজ এই দশা...”
“বাবা তুমি কি বলতে চাও স্পষ্ট করে বল।”
“আমি যা বলতে চাচ্ছি তা তুই ভালো মতই জানিস। আমি যা বললাম তাই ফাইনাল। কালোজাম, ছানা, আমিত্তি, সিঙ্গারা আর সমুচা। তুই বিকেলে গিয়ে “যাদব ঘোষ”এ গিয়ে অর্ডার করে আয়।“
“আমি পারবো না, তুমি যাও। কুলখানির নামে ভুঁড়িভোজ, আমি এতে নাই। তুমি ধর্মের কোথায় পেয়েছ কুলখানির নামে রাজ্যের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ডেকে খানাপিনায় মত্ত হওয়ার এই রীতি।”
“চোপ হারামজাদা, তোর কাছ থেকে আমার ধর্ম শিখতে হবে না। জুম্মাবারেও যে নামাজ পরে না, সে আসছে আমাকে ধর্ম শেখাতে।”
“ও তাই নাকি, জুম্মাবারে যারা নামাজ পড়ে, শুধু তারাই বুঝি ধর্ম’র কথা বলবে, ধর্ম শেখাবে। আচ্ছা বাবা, নামাজতো প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত পড়া ফরজ, তো সবসময় তুমি জুম্মাবারের কথা বল কেন? তুমি শুধু জুম্মা নামাজ পড় বলে...”
“চোপ হারামজাদা......”
বাবার চিৎকারে আমার কানে তালা লাগার যোগাড়। যদিও এমন হওয়ার কথা না, তারপরও আমি দ্রুত ঘর হতে বেরিয়ে এলাম, ড্রইং রুমে কিছু আত্মীয়-স্বজন বসে আছে, আমি সেদিকে না গিয়ে মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
“আপা একটু কাছে আসতো, তোমার মাথায় হিমরাজ তেল দিয়ে দেই।”
ছোট খালা এখন আছেন। কালকে ঘটনার পর থেকে আর বোধহয় বাসায় যাননি, যদিও তার বাসা আমাদের বাসা থেকে পাঁচ-ছয় বিল্ডিং পরেই।
“না বাদ দে, আমার কিছু লাগবে না” – মা শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছলেন।
কাল থেকে এই ভদ্রমহিলা কেঁদেই চলেছেন। মা’র জন্য খুব মায়া লাগছে, কিন্তু আমি কি করতে পারি?
“আপা দেখেছো তোমার বেয়াইনের রুচি। মরা বাড়িতে এটা কি খাবার পাঠাল? দোকান থেকে কিনে পাঠানো বিরিয়ানি।”
“প্লিজ এসব বাদ দে...” মা’কে খুব কেমন বুড়োটে লাগছে। মা’র চেহারা দেখে খুব মায়া লাগছে। কিন্তু আমার কিইবা করার আছে?
“কেন বাদ দেব? তোমরা কি ফকির? টাকা দিয়ে এই বিরিয়ানি আমরা কি কিনে খেতে পারিনা? মরা বাসায় চুলা জ্বলবে না বলেই তো আত্মীয়রা রেঁধে খাবার পাঠাবে।”
আমার খুব হাসি পাচ্ছিল, মাত্র একদিনে মৃত্যুর শোক কত ফিকে হয়ে আসে। শোক ঢাকা পড়ে যায় দৈনন্দিন জীবনের সাদামাটা চাওয়া-পাওয়ায়। আমি আমার ঘরে পা বাড়ালাম। সেখানে আমার বড় দু-বোন বসে আছে, মুখ থমথম। আমি বুঝার চেষ্টা করলাম ঘটনা কি? বেশীক্ষন অপেক্ষা করতে হল না। মেজপা মুখ খুলল।
“দ্যাখো বড়পা, এই মরাবাড়িতে এসব আলোচনা না করাই ভালো। লোকে শুনলে কি বলবে?”
“কি বলবে লোকে? বলুক, কিন্তু এখনি যদি একটা বিহিত না করা হয়, তবে ভাইয়ার বৌ মুন্নির লকেটসহ হারটা নিজের কাছে রেখে দেবে। আমি এটা হতে দেব ভেবেছিস। মুন্নির স্মৃতি, সেটা থাকবে মা’র কাছে, ভাবী কেন নিয়ে নিজের কাছে রাখলো।”
“আহ বড়পা, ভাবী কি বলেছে যে সেটা সে নিজের কাছে রেখে দেবে? মুন্নিকে গোসল দেবার সময় তা ভাবী খুলে নিজের কাছে রেখেছিল। পরে হয়ত মাকে দিয়ে দিবে। এসব বাদ দাও, একটু কোরআন তেলাওয়াত কর।”
“তা তো করবোই, আমি বসে বসে মনে মনে তজবি পড়ছি। কিন্তু বহ্নি তুই জানিস না, সব বাড়িতে এই হয়, মৃত মানুষের জিনিসপত্র হরিলুট হয় প্রথম দিকেই।”
আমার অসহ্য লাগছে। আমি বাড়ীর বাইরে বের হলাম। এখানেও কিছু মানুষের জটলা। ঐতো বড় দুলাভাই, লোকটাকে দেখেই আমার মাথায় রক্ত চড়ল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, গা গুলিয়ে যেন বমি হবে; যদিও তা হবার নয়। কারন আমি এখন এসবের ঊর্ধ্বে। গতকাল ভোররাতে আমি মারা গেছি, মারা গেছি বললে ভুল হবে, আমি আত্মহত্যা করেছি। আমার মৃত্যুযে আত্মহত্যা তা আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা, আমি সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেছি। হাসপাতাল রিপোর্টে এসেছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে। আমি কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট ছিলাম বিঁধায় আমার জন্য সায়ানাইড যোগাড় করা খুব সহজ ছিল।
No comments